২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১৬

গবাদি পশুর খাদ্য সংকট, বাড়ছে রোগবালাই

বন্যায় লাখো গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, হাজারো মৎস্য খামার আক্রান্ত হয়েছে। চারণভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। খড়-ঘাসসহ গোখাদ্য বিনষ্ট হওয়ায় না খেতে পেয়ে গবাদি পশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কোথাও কোথাও মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, কবলিত এলাকায় গবাদি পশু তড়কা, বাদলা, খুরা রোগসহ অনেক রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। দ্রুত প্রতিকার না পেলে এসব রোগ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গবাদি পশুর রোগবালাই নিয়ে মাঠে মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। চিকিৎসাসহ টিকা দেওয়া হচ্ছে। গোখাদ্য সংকট নিরসনে ত্রাণ হিসেবে গোখাদ্যের সহায়তার প্রক্রিয়া চলছে।
গাইবান্ধার কবলিতরা বলছে, সামনে কোরবানির ঈদ। গৃহপালিত গরু-ছাগলই তাদের বার্ষিক অর্থনৈতিক শক্তি জোগায়। কিন্তু বন্যায় গবাদি পশু আক্রান্ত হওয়ায় এবার তা হবে না। একদিকে ফসলহানি, অন্যদিকে গবাদি পশুর দুরবস্থা—সব মিলিয়ে বড় বিপাকে পড়েছে তারা।
শেরপুরে চর এলাকার কৃষক রহিম মিয়া বলেন, ‘আমার ছয়টা গরু আছে। বন্যায় ক্ষেতখামার তলাইয়া আছে। খেরও (খড়) নাইক্যা, কী আর করমু। গরুগুলার খাবার জোগানের নাইগ্গা কিছু ঘাস কাইট্টা আনছি। ঠিকমতো খাবার দিতে না পারার কারণে গাইয়ের দুধ কম হচ্ছে। ’
এদিকে হাজার হাজার পুকুর থেকে চাষের মাছ ও পোনা ভেসে যাওয়ায় বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে মৎস্য চাষিরা। তারা সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে। যদিও জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে কাজ শুরু করেছে তারা। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের বিনা মূল্যে মাছের পোনা দেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পাঠানো হবে। বিস্তারিত আমাদের আঞ্চলিক অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে :
নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকার ১০ ইউনিয়নে এবারের বন্যায় ৩৩ হাজার ৪৮৭টি গবাদি পশু আক্রান্ত হয়েছে। এসব এলাকায় চার হাজার ৮৪৮ গবাদি পশু-পাখিকে চিকিৎসাসহ টিকা দেওয়া হয়েছে। দুই উপজেলায় ২২ একর গবাদি পশুর চারণভূমি প্লাবিত হয়। ফলে বিনষ্ট হয়েছে এক লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকার দানাদার খাদ্য। পাশাপাশি নষ্ট হয়েছে ৫৪ হাজার টাকার গরুর খাদ্য ধানের খড়। মোট ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা।
কুড়িগ্রামে বন্যায় মৎস্য ও পশুসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখনো কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই। বন্যাকবলিত এলাকায় গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চারণভূমি ডুবে যাওয়ায় এবং ঘাস খাবারের অনুপযোগী হওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। বাধ্য হয়ে কাশ, বাঁশের পাতাসহ নানা ধরনের খাদ্য খাবার হিসেবে ব্যবহার করছেন তাঁরা। কিন্তু এসব খাবার খেয়ে গবাদি পশু আক্রান্ত হচ্ছে রোগ-ব্যাধিতে। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ছয়টি উপজেলার এক হাজার ৫৯৪টি পুকুর নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ২৬৩ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। যার মূল্য দুই কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তবে সরকারিভাবে কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মৌলভীবাজারে বন্যাকবলিত হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন এলাকায় গরু, মহিষ, ছাগল ও মোরগের মৃতদেহ পানিতে ভাসতে দেখা গেছে। তবে জেলা পশুসম্পদ কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া বন্যায় কোনো পশু মৃত্যুর খবর তাঁরা পাননি। স্থানীয়রা বলছে, গবাদি পশু রক্ষায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চার হাজার ৩৮৯ মেট্রিক টন দানাদার খাবার ও তিন হাজার ১২১ মেট্রিক টন খড় চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।
জেলার সাতটি উপজেলায় বন্যার পানিতে চার হাজার ২২৫টি পুকুর ডুবে গেছে। অনেক পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। পুকুরগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর পুকুর থেকে ভেসে যাওয়া মাছের ক্ষতির পরিমাণ ৫৩ কোটি ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি-ধুনট ও সোনাতলার চরাঞ্চলের বানভাসিরা গবাদি পশু নিয়ে পড়েছে চরম বিপাকে। সর্বস্বান্ত হয়েও শেষ সম্বল গবাদি পশু রক্ষা করতে পারছে না। এদিকে বন্যায় এই তিনটি উপজেলায় মৎস্য চাষিদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে মৎস্য বিভাগ বলছে, ক্ষতির পরিমাণ এক কোটির ওপরে। বগুড়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রওশন আরা বেগম বলেন, তাঁদের পরিসংখ্যান অনুসারে বন্যায় তিন উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৯৩টি গ্রামের ১০০টি পুকুরে থাকা প্রায় ২৬ টন মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার ওপরে হবে।
শেরপুর সদর উপজেলার চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত তিন ইউনিয়নের মধ্যে কামারেরচর ও চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের কৃষকরা গৃহপালিত পশু নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের জেগে ওঠা বিশাল চর গবাদি পশুর গো-চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বন্যার পানিতে অনেক গোয়ালঘর ও গো-চারণভূমি ডুবে গেছে। ফলে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি নামার পর গবাদি পশুর নানা রোগ-ব্যাধি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তারা। ফলে সরকারি সহযোগিতা কামনা করেছে তারা।
জামালপুরে গো-খাদ্যের সংকট রয়েছে। এ ছাড়া দেড় সহস্রাধিক পুকুর ভেসে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছে মৎস্য চাষিরা। দুর্গম চরাঞ্চল ইসলামপুরের সুরুজ মণ্ডল বলেন, ‘বানের পানির জন্য গরু-ছাগলের ঘাস মরে গেছে। খড়ের পালাও বানে ভাইসা গেছে। ঘাস ও খড়ের অভাবে গরু-ছাগল পালা খুবই কষ্ট হইছে। ’ জামালপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আবদুল মজিদ জানান, বন্যায় এ বছর জেলার এক হাজার ১৩৪টি পুকুর ভেসে যাওয়ায় পাঁচ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার টাকা মূল্যের মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় মৎস্য চাষি ও খামারিরা ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের সরকারিভাবে কোনো ঋণ বা ত্রাণ সহায়তার সুযোগ নেই। ’
গাইবান্ধার ফুলছড়ির আজাহার আলী জানান, চার উপজেলার চরবাসী মূলত গবাদি পশু পালনের ওপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য চরের ঘাসই যথেষ্ট। এখনো বন্যার পানিতে জমির বেশির ভাগ অংশ ঢেকে আছে। হাতে অর্থ না থাকায় বাইরে থেকে গো-খাদ্য ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঘাসের অভাবে পশুগুলো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্র জানায়, চার উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে এক লাখ ১৯ হাজার গবাদি পশু বন্যার কবলে পড়ে। খাদ্যাভাবে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল লতিফ জানান, গবাদি পশুর পরিচর্যায় তাঁদের সাতটি টিম কাজ করছে। চিকিৎসার জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। অসুস্থ পশুগুলোকে দ্রুত ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। বন্যায় মৎস্য খামারিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চার উপজেলার ৩৩৬টি পুকুর, দিঘি, খামারের বড় মাছ ও পোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ৮২.৫৪ হেক্টর খামার ভেসে গেছে।
সিরাজগঞ্জে গবাদি পশু ও মৎস্য খামারিরা বিপাকে পড়েছে। গবাদি পশুর ঘাস চাষে ব্যবহৃত ৪০ শতাংশ জমির চারণভূমির প্রায় ২০ শতাংশই বন্যায় তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া এবারের বন্যায় তলিয়ে গেছে জেলার ২৮৮টি মাছ চাষের পুকুর। তবে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এবারের বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে এরই মধ্যে কাজ করা হচ্ছে।
জেলার গোমারের বড় অংশ শাহজাদপুরের খামারিরা বন্যার পানির কারণে এরই মধ্যে তাদের গরু নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে তাদের পশু নিয়ে উঁচুতে থাকা নিজ বাড়িতে পালন করছে। আর বন্যার কারণে গো-চারণভূমি পোতাজিয়ার বাস্তায় পানি ওঠার কারণে পশুর খাবার আনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে এ অঞ্চলের খামারিদের।
সিলেটে মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত খামারিদের চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। বন্যায় জেলার এক হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন মাছের ক্ষতি হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য অফিস। তবে বন্যায় প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেছে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় সিলেট জেলার ৯টি উপজেলার সাত হাজার ২৯৪টি পুকুরে মাছের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরগুলোর আয়তন প্রায় ৫৩৪ হেক্টর। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোলাপগঞ্জ উপজেলা। সেখানকার চার হাজার ১৪৫টি পুকুরের ৬০৭ টন মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মূল্য সাত কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় তিন কোটি ৫৭ লাখ ৯২ হাজার টাকার, জৈন্তাপুর উপজেলায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা, দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় এক কোটি ২৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা, বালাগঞ্জ উপজেলায় এক কোটি ১১ লাখ টাকা, জকিগঞ্জ উপজেলায় ৮২ লাখ টাকা, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৩৩ লাখ টাকা এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকার মাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা করা হচ্ছে। কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। হয়ে গেলে আমরা তালিকা প্রধান কার্যালয়ে পাঠাব। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/22/522301