২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১৫

রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ

তিন পক্ষের সমন্বয়হীনতা দুর্ভোগ ২ লাখ শিক্ষার্থীর

তিন পক্ষের সমন্বয়হীনতায় দুর্ভোগে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থী। প্রায় ছয় মাস আগে এই সাত কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও এত দিন পরীক্ষা, রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, ভর্তিসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃপক্ষ একত্রে বসে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। দুই বিশ্ববিদ্যালয় আর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতায় বিপদে পড়ে দুই লাখ শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের অব্যাহত চাপ ও আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করলেও সমস্যা কাটেনি। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের জের ধরে গতকাল শুক্রবার বেনামি এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। এতে আরো ফুঁসে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। আজ শনিবার শাহবাগে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। মামলা প্রত্যাহার এবং পরীক্ষার সূচি ঘোষণার দাবিতে গতকাল মিছিল করেছে ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ১৮ জুলাই সাত কলেজের অধ্যক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে। সেখানে মাস্টার্স শেষ বর্ষ পরীক্ষা ১০ সেপ্টেম্বর, অনার্স তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষা ১৬ অক্টোবর এবং ডিগ্রি প্রথম ও তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা ৪ নভেম্বর শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিগ্রি এবং মাস্টার্সের প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয় ২৫ জুলাই থেকে ২৯ আগস্ট। এ ছাড়া ওই সাত কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয় সভায়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরই মধ্যে পরীক্ষা কমিটি হয়েছে। প্রশ্ন প্রণয়নের কাজও শেষ হয়েছে। এরপরই পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন
কোনোভাবে একটা তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা মোটেও ঠিক নয়। অচিরেই পরীক্ষার সূচিও প্রকাশ করা হবে। ’
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির এই সভাপতি বলেন, ‘এত দিন টেকনিক্যাল কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এই সাত কলেজ অধিভুক্ত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়—তিন পক্ষেরই ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। একে অপরকে সহযোগিতা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। আর এই সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে। তবে তা কাটিয়ে ওঠা নির্ভর করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর। ’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো বলছে, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সব তথ্য তারা পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার আগে যাদের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তাদের টেব্যুলেশন শিট রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার অনেক তথ্য না থাকায় শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষা কার্যক্রম সঠিক সময়ে শুরু করা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাহলুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের টেব্যুলেশন শিট ও লিখিত পরীক্ষার নম্বরের অভাবে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা যাচ্ছে না। অনেক আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন জানানো হলেও এখনো পাওয়া যায়নি। এতে ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর থাকলেও লিখিত পরীক্ষার নম্বর না থাকায় চূড়ান্ত ফল প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে না। লিখিত পরীক্ষার নম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আছে। ’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের কিছু তথ্য পাঠিয়েছে। আর যা বাকি আছে সেটাও তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।
তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে কম্পিউটারে থাকা ওই সব তথ্য আদান-প্রদানে ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি রয়েছে একেবারেই নিশ্চুপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং ইউজিসি কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই সাত কলেজের দায়দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ বিষয়ে তাদের কিছুই করণীয় নেই।
ওই সাত কলেজের একটির অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও আমরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত। প্রশাসনিক বিষয়ে আমাদের যোগাযোগ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তাই আমরা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সমস্যার বিষয়টি জানিয়েছি। এমনকি শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যেতে পারে সেটাও জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিভুক্ত এই সাত কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দৈনিক কাজ করার চুক্তিতে কিছু লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেককে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সান্ধ্যকালীন কোর্সে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এ ছাড়া অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজেও রয়েছে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর অতিরিক্ত চাপ সামলানোর পর্যায়ে নেই। এর ওপর নতুন করে অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ নিয়ে বড় বেগ পেতে হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় ছয় মাস পিছিয়ে পড়েছে।
সরকারি বাঙলা কলেজের ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চতুর্থ বর্ষের পড়াশুনা শেষ হয়েছে ছয় মাস আগে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম পূরণ এখনো শুরু হয়নি। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা কলেজগুলোর ফরম পূরণ শেষে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে। ’
জানা যায়, ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গত বছরের ২৮ অক্টোবর এক সভায় সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ওই সিদ্ধান্তের বিষয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ২১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৮৪টি কলেজকে ভাগ করে দিতেও সুপারিশ করে এ বিষয়ে গঠিত কমিটি। কিন্তু ১৭৭টি কলেজ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভাগ করা না হলেও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেওয়া হয় রাজধানীর সাত কলেজ।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। তাঁদের বিভিন্ন বক্তব্যেও দ্বন্দ্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে। সরকারি কলেজ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিতে সরকারের আগ্রহ প্রকাশের পর থেকেই রাজধানীর নামি কলেজগুলো বাগিয়ে নিতে উঠেপড়ে লাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা না করে কোনো কোর্স কারিকুলাম বা পরিকল্পনা না করেই সাতটি কলেজ নিয়ে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অসহযোগিতা করে। এতে বড় ধরনের সংকটে পড়ে দুই লাখ শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অধিভুক্তির নির্দেশনা পাওয়ার পর কাজ শুরু হয়েছে। এখনো সেই কাজ চলছে। তথ্যসংক্রান্ত জটিলতা থাকলেও শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছে। কয়েকটি পরীক্ষার সময়ও নির্ধারণ করা হয়েছে। সমস্যা সমাধানে অধ্যক্ষদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে পরীক্ষার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/07/22/522308