সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে পাহাড় ধসে মা ও ভাইকে হারিয়ে শিশু জান্নাতের বুকফাটা কান্না -যুগান্তর
২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১৪

এ কান্নার শেষ কোথায়

চট্টগ্রামে ফের পাহাড় ধসে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু

চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধসে নিহত ১৫৮ জনের পরিবারে কান্না থামেনি এখনও। এখনও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি ক্ষতিগ্রস্ত ৬ হাজারের বেশি পরিবারের জীবন। এর মধ্যেই চট্টগ্রামে আবারও ঘটল পাহাড় ধসের ঘটনা। বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুরের ছিন্নমূল এলাকায় মাটিচাপায় ঝরে গেল পাঁচ প্রাণ। সবাই একই পরিবারের, আর এদের তিনজনই শিশু। এর মধ্যে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে দুই সন্তান নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন এক গৃহবধূ।


আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে বুধবার রাত থেকে ভারি বর্ষণ হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। প্রবল বর্ষণে মাটি নরম হয়ে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাসিন্দাদের ওপর ভেঙে পড়ে পাহাড়।

নিহতরা হলেন- দিনমজুর মো. রফিকুল ইসলামের স্ত্রী বিবি ফাতেমা (৩০), তার ছেলে ইউনুস (১০), রফিকের বোন রাবেয়া বেগম (২৫) ও তার দুই মেয়ে সামিয়া (৭) ও তানিয়া (২)। এ ঘটনায় আহত হন আরও চারজন। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৩০ জন প্রাণ হারালেন পাহাড় ধসে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার মিলিয়ে এ সংখ্যা ১৬৫। আর শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১১ বছরে ঝরে গেছে ২৩১ প্রাণ। বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে, চার দশকে পাঁচশ’র বেশি প্রাণ ঝরেছে পাহাড়ের মাটিচাপায়।

সলিমপুরের বাসিন্দা নাসিমা আক্তার যুগান্তরকে জানান, ভারি বর্ষণের এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার রাতে মাটি ধসে রফিকের ঘরের ওপর পড়ে। এতে ঘর ভেঙে তারা চাপা পড়েন। এর ভেতর থেকে রফিক কোনোমতে বেরিয়ে এসে পাশের পাহাড়ের বাসিন্দাদের খবর দেন। স্থানীয় লোকজন ছ–টে গিয়ে রফিকের দুই মেয়ে সালমা (১২) ও জান্নাত (১৪) এবং রফিকের ভাই মো. গিয়াস উদ্দিনকে (৩৭) আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে স্থানীয় লোকজন এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। ভোর ৪টার দিকে মাটি সরিয়ে ইউনুস, রাবেয়া, লামিয়া ও তানিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে উদ্ধার হয় ফাতেমার লাশ। ফাতেমা বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার শিরিন গার্মেন্ট অ্যান্ডি টেক্সটাইলে সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে খাস জমিতে টিন দিয়ে ঘর বানিয়েছিলেন দিনমজুর রফিক। মাটির সিঁড়ির ৪০ ধাপ পেরিয়ে সেই ঘরে উঠতে হতো। স্ত্রী, ছেলে, বোন ও ভাগ্নিদের হারিয়ে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছেন না রফিক। তিনি বলেন, স্ত্রী ফাতেমা, দুই মেয়ে ও ভাইকে নিয়ে সেখানে থাকতেন তিনি। কয়েকদিন আগে নোয়াখালী থেকে সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে আসেন বোন রাবেয়া। বাঁচল না তারাও।

সকালে ঘটনাস্থলে আসেন জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী, পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা এবং সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরে যেতে নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, ১৫ দিন আগেও এ এলাকায় মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কোনো পরিবার সরে গেলেও পুনরায় তারা সেখানে এসে বসবাস শুরু করে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিন জানান, পাহাড় ধসের ফলে ঘরের একাংশ ভেঙে পড়ে। এর নিচে চাপা পড়েন পরিবারের সদস্যরা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ট্রেনিং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পাহাড়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এর মধ্যে পাহাড়ের পাদদেশে টিনের ঘর বানিয়ে বসবাস করছিল তারা। পাহাড় ধসে ঢাল দিয়ে নামা মাটি সরাসরি ঘরের ওপর পড়েছে। এ কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’

সলিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ যুগান্তরকে বলেন, দু’দিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ে। তিনি জানান, সলিমপুর ইউনিয়নের আলী নগর, ছিন্নমূল ও মুক্তিযোদ্ধা বসতি নগর এলাকায় প্রতিদিন পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকারি এসব পাহাড় কাটা হলেও প্রশাসন তা বন্ধে এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

স্থানীয় বাসিন্দা মাহফুজা বেগম লিমা যুগান্তরকে জানান, ছিন্নমূল পাহাড়টি কাটছে মশিউর রহমান নামে এক লোক। এক মাস আগে জেল থেকে বের হয়ে ওই লোক আবারও পাহাড় কাটছে। তিনি বলেন, ভূমিদস্যুরা গ্রেফতার না হলে পাহাড় কাটাও বন্ধ হবে না। পাহাড়ের মৃত্যুঝুঁকিও কমানো যাবে না।

সূত্র জানায়, জঙ্গল ছলিমপুর এলাকার ছিন্নমূল পাহাড়ে লক্ষাধিক লোকের বসবাস। সরকারি দলের নেতাদের সহযোগিতায় তারা এখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রশাসন চাইলেই এখান থেকে লোকজনকে উচ্ছেদ করতে পারে না। উচ্ছেদ বা পাহাড় কাটা ঠেকাতে গেলেই সরকারি দলের লোকজন ও নেতারা বাধা হয়ে দাঁড়ান। অনেক সময় প্রশাসনও এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখায়।

এ বছর (২১ জুলাই পর্যন্ত) পাহাড় ধসে নিহত ১৬৫ : জেলা প্রশাসনের হিসাবে রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ১২ ও ১৩ জুন পাহাড় ধসে ১৫৫ জন মারা যান। এর ৫ দিন পর ১৮ জুন খাগড়াছড়িতে মারা যান ৩ জন। এ নিয়ে এ চার জেলায় ওই সময়ে পাহাড় ধসে প্রাণ যায় ১৫৮ জনের। এর বাইরে ১৮ জুন মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পাহাড় ধসে মারা যান দু’জন। বৃহস্পতিবার মারা গেলেন ৫ জন।

১১ বছরে চট্টগ্রামে নিহত ২৩১ : জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ১২৭ জন নিহত হয়েছিল। ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০০৯-এ ৩, ২০১০-এ ৩, ২০১১-তে ১৭, ২০১২-তে ২৮, ২০১৩-তে ২, ২০১৪-তে ১ এবং ২০১৫ সালে ৬ জন মারা যান। ২০১৬ সালে কেউ মারা না গেলেও এ বছর ১৩ জুন রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশে ২৫ জন মারা যান।

নোয়াখালীতে কান্না : নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নিহতদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার আন্ডারচর ইউনিয়নের পূর্ব মাইজচরা গ্রামে। বিকাল ৫টার দিকে তাদের লাশ পূর্ব মাইজচরা গ্রামে এসে পৌঁছে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্য ও স্বজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। আত্মীয় নুরনবী মাঝি জানান, ৮ বছর আগে রফিকুল নোয়াখালী থেকে সীতাকুণ্ডে যায়। পরে সেখানে তারা সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করে। রাত ৮টায় (শুক্রবার) পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। নোয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সোহেল রানা যুগান্তরকে লাশ পৌঁছার তথ্য নিশ্চিত করেন।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/22/141823/