২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১২

ভুয়া প্রকল্পে ২৪ কোটি টাকা!

শুধু মাগুরা জেলাতেই ১ হাজার ৭৭৬টি ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ২৪ কোটি টাকার খয়রাতি সাহায্য (জিআর) বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বরাদ্দের ৯৫ শতাংশই ওয়াজ মাহফিলের জন্য। এই বরাদ্দে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এক সপ্তাহ ধরে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, খয়রাতি সহায়তা হিসেবে দেওয়া এই ১ হাজার ৭৭৬টি প্রকল্পের বেশির ভাগই ভুয়া। বরাদ্দ দেওয়া হলেও অনেক জায়গায় দেখা গেছে, ওয়াজ মাহফিলই হয় না। নামযজ্ঞ হয় মন্দিরে বা মন্দিরের বাইরে খোলা জায়গায়। এ ক্ষেত্রেও ভুয়া প্রকল্প দেখানো হয়েছে। প্রকল্পে যাঁদের নাম-পরিচয় দেওয়া আছে, তাঁদের কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। কে বা কারা প্রকল্পগুলো পাঠিয়েছেন, তাও তাঁদের অজানা।
মাগুরা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ৬ হাজার ৩৬৩ টন চাল খয়রাতি সাহায্য হিসেবে দেওয়া হয়েছে। টাকার হিসাবে বরাদ্দের পরিমাণ ২৪ কোটি টাকা। এ বছর টনপ্রতি খাদ্য বিভাগ মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৭ হাজার ৮৩৬ টাকা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মন্ত্রণালয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মসজিদ, বিদ্যালয় সংস্কারসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তার জন্য আবেদন করেন। কিছু আবেদন বিবেচনা করে অনুমোদন দিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কর্ণধার কমিটি এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে বরাদ্দ ছাড় করেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষে দেশের কোথায় কোন প্রতিষ্ঠানের নামে জিআর বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, তা জানা সম্ভব নয়। প্রকল্পগুলো খতিয়ে দেখার দায়িত্ব জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মূলত মাগুরা জেলার দুই সাংসদ যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার ও মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল ওয়াহাবের আধা সরকারি পত্র (ডিও) অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে ওই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে বিভিন্ন সময়ে এলাকার লোকজন নানা অনুষ্ঠানের জন্য জিআর বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করলে আমি সম্মতি দিয়েছি। তবে এমনও শুনেছি, আমার অফিশিয়াল প্যাড ও সই নকল করে অনেকে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খতিয়ে দেখতে পারে।’
আবদুল ওয়াহাব অবশ্য বলেছেন, জিআর বরাদ্দ সম্পর্কে তিনি ভালোমতো জানেন না। এটা কারা কেন পেয়েছেন, তিনি তা জানেন না।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহ হওয়ায় প্রকল্পগুলো তদন্ত করতে বলা হয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প সঠিক নয়। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছেন না।
প্রকল্পের নামসহ মন্ত্রণালয়ের ওই বরাদ্দের চিঠি গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে উপবরাদ্দ হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মাগুরা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠায়। জুনের আগেই বরাদ্দ শেষ করার তাগিদ থাকে। তার আগে ওই মন্ত্রণালয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের ভিড় লেগে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাই সরকারি দলের হওয়ায় সবাই যাঁর যাঁর মতো চাপাচাপি করেন। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব শাহ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সচিব বলেন, খয়রাতি সাহায্য সব বছর থাকে না। গত বছর বন্যা না হওয়ায় কিছু চাল ছিল, এবার বন্যা হওয়ায় তা থাকবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সারা দেশে খয়রাতি সাহায্য দেওয়া হয় না। ১০-১২টি জেলায় দেওয়া হয়। এর পরিমাণ এক থেকে সর্বোচ্চ তিন টন।
প্রকল্প নেই, তবু বরাদ্দ
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সদর উপজেলায় ১ হাজার ১১৬টি প্রকল্পের জন্য ৪ হাজার ৮৭ টন, শ্রীপুরে ১২১ প্রকল্পে ৩৯৮, শালিখায় ২২৭ প্রকল্পে ৬৯৭ এবং মহম্মদপুরের ৩১২টি প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ১৮১ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া সব প্রকল্পেই ৩ টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মহম্মদপুর উপজেলার বড়রিয়া গ্রামে ৯টি ওয়াজ মাহফিলের জন্য ২৭ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে মসজিদ থাকলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো ওয়াজ মাহফিল হয়নি। প্রকল্পগুলোর একটি বড়রিয়া ফকিরবাড়ি এতিমখানা প্রাঙ্গণে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলের জন্য। এ প্রসঙ্গে ফকিরবাড়ির আবুল খায়ের ফকির বলেন, ‘আমাদের একটি মসজিদ আছে। এতিমখানা নেই। এখানে কখনো ওয়াজ মাহফিল হয়নি। অনুদান পেতে কোথাও আবেদনও করিনি।’
একই গ্রামের বিশ্বাসপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে ওয়াজ মাহফিলের নামে একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, সেখানে কোনো দিন ওয়াজ মাহফিল হয়নি।
শালিখা উপজেলার ৫০টি প্রকল্পের জন্য দুবার করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শালিখার ইউএনও সুমি মজুমদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সদর উপজেলার ডেফুলিয়া গ্রামে ৬টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পেরও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ‘মাদ্রাসা মাঠ প্রাঙ্গণে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল’ প্রকল্প সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসার এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মহল্লাবাসীর সহযোগিতায় শীতকালে মাদ্রাসা মাঠে ওয়াজ মাহফিল করি। তা-ও গত তিন বছর করতে পারিনি। মাহফিল করতে সরকারি সাহায্য নেওয়া হয় না।’
সদরের লস্করপুর পালপাড়া সর্বজনীন মন্দির ও আন্দোলবাড়িয়া সর্বজনীন কালীমন্দির নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ এ দুটি মন্দিরের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এসব উদ্যোগে নানা ধরনের বিচিত্র অনিয়মের ঘটনা ঘটে, যা খুবই দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অপরাধীরা সুরক্ষা পাবে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1260816/