রাজধানীর ৩০০ ফুট রাস্তার পূর্বাচলের ডুমনী এলাকার একাংশ। বালু নদের কাছে ডুমনী এলাকায় খাল খননের কাজ চলছে (ইনসেটে)। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি l সাজিদ হোসেন
২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১১

সরু হচ্ছে ৩০০ ফুট রাস্তা

সড়কের নাম ‘৩০০ ফুট রাস্তা’। এ নামেই সবার কাছে পরিচিত। কিন্তু প্রশস্ত সড়কটি রাজধানীর কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার অংশে তার নামের সার্থকতা ধরে রাখতে পারছে না। দুই পাশে ৬৫ ফুট কাটা পড়ছে এটি। তাতে ৩০০ ফুটের বদলে সড়কটির প্রশস্ততা কমে দাঁড়াবে ২৩৫ ফুট। বাদ যাবে দুই পাশের সার্ভিস সড়ক এবং সেই সঙ্গে আইল্যান্ডের কিছু অংশ।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সড়কের দুই পাশে ১০০ ফুট চওড়া দুটি কৃত্রিম খাল খনন করা হচ্ছে। শুরুতে খাল দুটি সড়কের প্রান্ত ঘেঁষে তৈরি করার কথা থাকলেও এখন এই খাল দুই প্রান্তে ৩২ ফুট করে সড়কের ভেতরে ঢুকে পড়বে। দুই পাশের বেসরকারি কিছু আবাসন প্রকল্পের সার্ভিস সড়ক নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য মূল সড়কের অঙ্গহানি ঘটানো হচ্ছে।
গত ৩০ জুন রাজউকের বোর্ড সভায় ১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পে ৩০০ ফুট রাস্তার জমি ব্যবহারের বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে। ৮ জুলাই খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর আরবান স্টাডির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ৩০০ ফুট চওড়া সড়কের বিষয়টি রাজউকের মূল পরিকল্পনায় ছিল। সড়ক প্রশস্ত করার বদলে ছোট করাটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, পূর্বাচল উপশহর ভবিষ্যতে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাসের শহর হবে। সে মানুষগুলোর কী হবে? তাঁদের চলাচলের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সেখানে রেল যোগাযোগের কথা ছিল, তা-ও বাদ দেওয়া হয়েছে।
রাজউকের প্রকল্পটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সড়কের দুই পাশের কিছু বেসরকারি প্রকল্পের সুবিধা করে দিতে খালের জন্য অধিগ্রহণ করা জায়গায় (খালের অপর প্রান্তে) প্রায় ৩০ ফুট চওড়া আরও দুটি সড়ক তৈরি করে দেওয়া হবে। তাতে খাল সরে এসে ৩০০ ফুট সড়কের কিছু অংশ নিয়ে নেবে। খাল সরিয়ে না আনলে ওই দুটি সড়ক তৈরির জন্য আরও জায়গা অধিগ্রহণ করতে হতো। তাতে নতুন করে খরচ হতো প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এমনিতেই খালের জায়গা চড়া দামে (প্রতি শতাংশ ৪৭ লাখ টাকা) অধিগ্রহণ করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ৩০০ ফুট সড়কটি কিছুটা ছোট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দুটি খালের প্রস্থ ১০০ ফুটই থাকছে। খালের পরে যে সার্ভিস সড়ক ও ফুটপাত হচ্ছে, তারও দরকার আছে। বেসরকারি কোনো উন্নয়নকারীকে কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন চেয়ারম্যান।
সড়ক বড় করার পরিবর্তে ছোট করা সংগত কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এলাকায় আরও সড়ক হবে।
রাজউক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পের ওপর দিয়ে যাওয়া ৩০০ ফুট সড়কটির গুরুত্ব ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ উত্তর দিক থেকে আসা সিলেট ও চট্টগ্রামগামী যানবাহন এই সড়ক ব্যবহার করছে। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে যেসব যাত্রী সিলেট ও চট্টগ্রামের দিকে যান, তাঁদেরও অনেকে রাজধানীর ভয়াবহ যানজট এড়ানোর জন্য এই পথ ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত অর্থে ৩০০ ফুট রাস্তা কেটে খালের ওপারে সার্ভিস সড়ক তৈরি করে লাভবান করা হবে বেসরকারি আবাসন ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ৩০০ ফুট সড়ক ছোট করা হলে সেটা অবশ্যই অন্যায় হবে। কারণ, আগামী অন্তত ৪০ বছরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা মাথায় রাখলে ৩০০ ফুট সড়ক ছোট করাই যাবে না। ভবিষ্যতে এই সড়কপথে আন্তনগর গাড়ি চলাচল আরও বাড়বে।
১৪ জুলাই দুপুরে কুড়িল থেকে বালু নদের সেতু পর্যন্ত ৩০০ ফুট সড়ক এলাকা ঘুরে দুই পাশে আবাসন প্রকল্প, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি হাসপাতালের উন্নয়ন কার্যক্রম দেখা যায়। ছুটির দিন হলেও এই সড়কে চোখে পড়ে যানবাহনের ব্যস্ত চলাচল। মস্তুল এলাকায় চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলেন কয়েকজন বাসিন্দা। তাঁরা বলেন, সড়কটি আরও চওড়া হলে আরও ভালো হতো। ইমদাদুল আলম নামের একজন বাসিন্দা বলেন, ৩০০ ফুট সড়কটি ছোট করা হবে, এমন একটি খবর তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেননি।
ডুমনী এলাকায় সড়কের দক্ষিণ পাশটি ছোট ছোট লাল পতাকায় সজ্জিত। সেখানে একযোগে তিনটি এক্সকাভেটর দিয়ে খালের খননকাজ চলছে। কর্মরত রেজিকুল ইসলাম ও আফজাল হোসেন নামের দুজন শ্রমিক। বললেন, পানি সেচের কাজে তাঁদের মেশিন কাজ করছে। গতকাল থেকেই কাজে তত্ত্বাবধান করছেন তাঁরা।
রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৩০০ ফুট সড়কের দুই পাশে বক্স কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছে সেখানে ১০০ ফুট চওড়া দুটি উন্মুক্ত খাল থাকতেই হবে। এই খাল ছোট করা যাবে না। রাজউক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বজায় রেখেই ১০০ ফুট চওড়া দুটি খাল করছে।
এখানে দুটি খালের জন্য জমি অধিগ্রহণে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেট ৭১২ কোটি টাকার। তবে বাস্তবতা বুঝে খরচ আরও বাড়তে পারে।
‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে¼১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা।
প্রকল্পটির বিস্তারিত লে-আউট, নকশা ইত্যাদি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধীন গবেষণা সংস্থা ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন (বিআরটিসি) সম্পাদন করছে। বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে সেনাবাহিনীর এসডব্লিউও (পশ্চিম)। প্রকল্পে ৩৯ কিলোমিটার হাঁটাপথ, চারটি ইউলুপ, খালের ওপর ১৩টি সেতু, চারটি এক্সপ্রেসওয়ে পদচারী-সেতু (ফুটওভারব্রিজ) ও পাঁচটি স্লুইসগেট থাকবে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1260841/