১৩ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:০১

ভুয়া টেস্টে ডক্টরস চেম্বার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রমরমা ব্যবসা

রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ কমেনি

রাজধানীজুড়ে চিকুনগুনিয়ার দাপটে আতঙ্কিত সর্বস্তরের মানুষ। ছেলে-বুড়ো কারোরই নিস্তার নেই এ অসুখ থেকে। এডিসবাহী মশা কামড়ালে আর কারো নিস্তার নেই। আর এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এর অসহ্য যন্ত্রণা উপলব্ধি করার উপায় নেই। মানুষের কষ্ট যা-ই হোক না কেন চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবে দুই শেণীর মানুষ কিন্তু দারুণ লাভবান হয়ে। এরা হলোÑ চিকিৎসক এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাব। হাসপাতাল, ল্যাব, ডক্টরস চেম্বার সর্বত্রই এ সংক্রান্ত রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।
গত ৭ জুলাই বিবিসি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রতি ১১ জনে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। শুরুর দিকে চারটি এলাকায় এ মশার বিচরণের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও বর্তমানে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ঘরে রয়েছে এ রোগী। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত মানুষের ভিড়। এ জ্বরে আক্রান্তদের জন্য প্রাথমিকভাবে খুবই সাধারণ চিকিৎসা থাকলেও না জানার কারণে একশ্রেণীর চিকিৎসক ও ডায়াগনসিসের লোকজন টেস্ট করার নামে রোগীদের পকেট কেটে নিচ্ছে ইচ্ছামতো, সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ডাক্তার দেখাতে ভিজিট লাগছে প্রতিজনে পাঁচ থেকে ৭ শ’ টাকা। আর টেস্টে ব্যায় হচ্ছে এক থেকে তিন হাজার পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ তত্ত্ব¡ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) কর্মকর্তারা বারবার বলছেন, লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় চিকুনগুনিয়া জ্বর পাঁচ থেকে সাত দিনে সুস্থ হয়ে যায়। টেস্ট করার প্রয়োজন নেই। টেস্ট করলে শুধু ভাইরাসের উপস্থিতি বের করা সম্ভব, জ্বরটি যে চিকুনগুনিয়ার কারণেই হয়েছে এটা বাংলাদেশের কোনো ল্যাবরেটরিতে বের করা সম্ভব নয় আইইডিসিআর ছাড়া। কর্মকর্তারা বলছেন, এ কারণে নির্দিষ্ট লক্ষণ স্পষ্ট হলেই চিকিৎসা দেয়া উচিত। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা জানিয়েছেন, আমরা সবার কাছে কাছে বারবার বলছি, চিকুনগুনিয়ার টেস্ট করানোর দরকার নেই। কিছু লক্ষণ আছে তা শরীরে দেখা দিলেই ধরে নিতে হবে চিকুনগুনিয়া হয়েছে।
মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা জানান, চিকুনগুনিয়া হলে হঠাৎ জ্বর এসে প্রচণ্ড গিঁটে ও মাথাব্যথা, ঠাণ্ডা অনুভূতি, বমি বমি ভাব, ত্বকে লালচে দাগ, মাংসপেশিতে ব্যথা হয়ে থাকে। উপসর্গের এক সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসটি পরীক্ষা করে বের করা যায় সেরোলজি ও আরটি, পিসিআর করে। আইইডিসিআরে চিকুনগুনিয়ার সব টেস্ট করা যায়।
তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাও নেই। নিয়ম করে প্যারাসিটামল খেতে হবে। এর সাথে প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। তিনি বলেন, গিঁটে ব্যথার জন্য ঠাণ্ডা অথবা গরম পানির ছ্যাঁক দিতে হবে। তাহলে রোগী আরাম বোধ করবেন। এর সাথে হালকা ব্যয়ামও করা যেতে পারে। প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পরও যদি গিঁটে ব্যথা থাকে তাহলে শিগগিরই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।’
চিকুনগুনিয়ার মূল পরীক্ষা আইইডিসিআর ছাড়া অন্য কোথাও হয় না। বাইরে শুধু অ্যান্টিবডি (আইজিজি ও আইজিএম) টেস্ট করা হয়, এর বাইরে কিছু হয় না। আইইডিসিআরে পিসিআর টেস্ট করা হয়। বাইরে অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হলে সেগুলো নেগেটিভ অথবা পজেটিভ হতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পজেটিভ বলার পর তা আইইডিসিআরে পরীক্ষার পর নেগেটিভ হয়েছে এমন ঘটনাও আছে। আবার দেখা গেছে, বাইরের টেস্টে চিকুনগুনিয়া হয়নি বলে রোগীকে বলে দিলেও আইইডিসিআরের টেস্টে তা পজেটিভ হয়েছে। সিনিয়র বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আলমগীর জানিয়েছেন, বাইরে কিট পদ্ধতির মাধ্যমে যে টেস্ট করা হয় তা নির্ভরযোগ্য নয়। আইইডিসিআরে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম দিনেই টেস্ট করা হলেও তা বলে দেয়া সম্ভব টেস্ট করে।
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় সবচেয়ে বেশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, মানুষ জ্বর নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এলেই চিকিৎসকেরা চিকুনগুনিয়া টেস্ট করে আনতে বলছেন। এমনই একটি হাসপাতালে মোহাম্মদ ইব্রাহিম (৩০) নামের একজনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘চিকিৎসকেরা এখন আর পরিশ্রম করতে চান না। তাদের কাছে গেলেই তারা টেস্ট করতে বলেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে লক্ষণ দেখে চিকিৎসা দিতে হবে। টেস্ট করার প্রয়োজন নেই। একজন বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছে গেলাম আর তিনি কত কিছু বললেন। ভয়ে টেস্ট করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি।’
ওই হাসপাতালে মোহাম্মদ ইব্রাহিম গেছেন মিরপুর থেকে। আরেকজনের সাথে কথা বললে তিনি জানালেন, তিনি এসেছেন নগরীর বাসাবো থেকে। দিলশান আক্তার নামের একজন বয়স্ক মহিলা এসেছেন রাজধানীর মহাখালী থেকে। আতিকুল কবির নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা থাকেন মহাখালীতে। তিনি গত মঙ্গলবার থেকে ভুগছেন চিকুনগুনিয়ার লক্ষণযুক্ত জ্বরে। তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছেন, টেস্ট করাতে যাননি। ধানমন্ডিতে থাকেন ডাক্তার আবিদুর রহমান ভুগছেন চিকুনগুনিয়ায়। তিনি বললেন, তিনি টেস্ট করাবেন না, এভাবেই প্যারাসিটামল ও অন্যান্য কিছু খেয়ে চলে যাবে বলে তিনি জানান।
রামপুরা বনশ্রী এলাকার সি ব্লকে ১০ নম্বর রোডে বাসার দারোয়ান আইয়ুব আলী তিন দিন পর গতকাল বুধবার উঠে দাঁড়াতে পারছেন। তিনি কোনো টেস্ট করাননি। ফার্মেসি ওয়ালার পরামর্শ মতো প্যারাসিটামল ও প্রচুর পানি পান করেছেন তিনি।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235254