১৩ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮

প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আড়ালে অর্থ লোপাট

তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দু’বছরেও রিপোর্ট জমা হয়নি * পিডিকে রক্ষা করতে মহলবিশেষ তৎপর

সরকারের শীর্ষ পর্যায় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর একটি ‘অটিস্টিক একাডেমি স্থাপন প্রকল্প।’ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন তথা অটিস্টিক, ডাউন সিনড্রোম ও সেলিব্রাল শিশুদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নেয়া হয় এই প্রকল্প। কিন্তু কর্মপরিকল্পনা, কিছু দিবস পালন ও প্রশিক্ষণেই শেষ হয়ে যায় প্রকল্পের প্রথম মেয়াদ। এই সুযোগে প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ জোরালো হওয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু কমিটি গঠনের দু’বছর পার হলেও তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। সূত্র বলছে, রিপোর্টের খসড়া চূড়ান্ত হলেও তার কোনো হদিস মিলছে না।


এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সালমা বেগম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘উল্লিখিত অভিযোগগুলো একেবারেই অসত্য। সরকারের আর্থিক বিধি এবং ডিপিপি (বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুসরণ করেই প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যয় করা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। পরক্ষণে বলেন, হলেও হয়ে থাকতে পারে। কারণ ওই সময় যিনি মহাপরিচালক (মাউশি) ছিলেন তিনি চাননি আমি পিডি হই। এজন্য আমি পিডি হওয়ার পর তিনি আমাকে নানাভাবে ফাঁসাতে চেষ্টা করেন। এর সূত্র ধরে মিথ্যা অভিযোগে তদন্ত কমিটি করেছেন।’

সূত্র জানায়, প্রকল্পের খরচের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও তিনি ২০১৫ সালের ২৯ জুন লিখিতভাবে তথ্য সরবরাহ করেন। এর আগে ১০ জুন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মাউশি পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামছুল হুদাকে ওই কমিটির প্রধান করা হয়। তখন তিনি ছিলেন প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক। আর কমিটির সদস্য ছিলেন উপপরিচালক হেমায়েতউদ্দিন হাওলাদার।

এরপর তদন্ত কমিটির কাজ শুরু হলে ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর খুলনার উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের (এইচএসটিটিআই) পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর খান মাউশির তৎকালীন মহাপরিচালকের কাছে প্রশিক্ষণের ওপর একটি প্রতিবেদন পাঠান। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, প্রশিক্ষণের ভেন্যু চিফ (পরিচালক) এবং কোর্স সমন্বয়কের (অতিরিক্ত পরিচালক) সঙ্গে কোনো প্রকার কার্যকর যোগাযোগ করেননি পিডি। তার একান্ত ইচ্ছায় সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (টিটিসি) একটি সম্মিলিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। প্রশিক্ষণ সামগ্রী পিডি ঢাকা থেকে সরবরাহ করেন, যা বরাদ্দকৃত অর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সূত্র জানায়, শুধু এই পরিচালকই নন, পাবনা, সিলেট, খুলনার টিটিসির তৎকালীন অধ্যক্ষরাও একই বিষয় লিখিতভাবে মাউশির তৎকালীন মহাপরিচালককে অবহিত করেন। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করলে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর বুধবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষা বিভাগে এইচএসটিটিআই’র প্রশিক্ষণের মান, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক স্বচ্ছতার একটা সুনাম আছে। কিন্তু অটিস্টিক একাডেমির প্রশিক্ষণ কোর্স আয়োজন করতে গিয়ে তাতে কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি হয়। প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়ে প্রশিক্ষণ সামগ্রী দেয়ার নাম করে আবার টাকা ফেরত নিয়েছেন। ব্যাগ, প্যাড, ফোল্ডারসহ যেসব প্রশিক্ষণ-সামগ্রী দেয়া হয় তার মান এমনই নিন্ম ছিল যে, এসব সামগ্রীর জন্য বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের সিকিভাগ দামও ছিল না। আবার ঢাকায় যে টাকা ফেরত নেয়া হয়, তার কোনো ব্যয় বিভাজন করে দেননি। ফলে হিসাব মিলিয়ে বাজেট সমন্বয় করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক ভেন্যুর প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। কিন্তু পিডি সাহেবের নির্দেশে এইচএসটিটিআইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও খুলনা টিটিসিতে একসঙ্গে করা হয়। দুটি অনুষ্ঠানের জন্যই প্রধান অতিথি হিসেবে যে সম্মানী নেয়ার কথা তা তিনি নিয়েছেন।

জানা গেছে, প্রকল্পের এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ব্যাগ, প্যাড, কলমসহ প্রশিক্ষণ-সামগ্রীর জন্য বরাদ্দ ছিল ৬০ হাজার টাকা। প্রথম অর্থবছরে (২০১৫-১৬) প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এ হিসাবে শুধু এ খাতে ২৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক নিয়মানুযায়ী এই টাকা একবার মাঠ পর্যায়ে পাঠিয়ে পরে তা আন-অফিসিয়ালি ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসেন। বলা হয়, তিনি ঢাকা থেকে ভালো মানের প্রশিক্ষণ-সামগ্রী কিনে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, উল্টো চিত্র। একেবারে নিন্মমানের প্রশিক্ষণ-সামগ্রী কিনে তিনি মোটা অংকের টাকা পকেটস্থ করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এদিকে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে কতটি প্রশিক্ষণ কোর্স হয়েছে তা নিয়েও তথ্যবিভ্রাট দেখা দিয়েছে। প্রকল্প থেকে প্রকাশিত ব্রুসিয়ারে বলা হয়েছে ৪৬টি। কিন্তু এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির কাছে পিডির লেখা জবাবে বলা হয়েছে ৬২টি। সেই হিসাবে ১৬টির হিসাবে গরমিল আছে। তদন্ত কমিটির কাছে সরবরাহকৃত তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি প্রশিক্ষণে ২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা করে বরাদ্দ থাকলে সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় দেখানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে পিডি সালমা বেগম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘কয়েকটি কারণে ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণ-সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। তা হচ্ছে, প্যাড-ব্যাগ ইত্যাদি তারা (ভেন্যু চিফ) মনোগ্রামসহ মানসম্মতভাবে ছাপাতে পারতেন না। তাছাড়া অনেকেই হয়তো টাকা যথাযথভাবে ব্যয় করতেন না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অল্প টাকার কেনাকাটা হওয়ায় টেন্ডার ডাকা যায়নি। তাই কোটেশনের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করা হয়। তবে পরবর্তী বিভিন্ন কাজে টেন্ডার করা হয়েছে। যেমন- পূর্বাচলে প্রস্তাবিত অটিস্টিক একাডেমি নির্মাণের নকশা তৈরির কাজটি টেন্ডারের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্প শুরু হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। প্রথম মেয়াদের তিন বছর এবং দ্বিতীয় মেয়াদের বর্তমান ৬ মাসে প্রকল্পের মাত্র ৩৬ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এ ব্যাপারে পিডি বলেন, জমির অভাবে প্রথম মেয়াদে প্রকল্পের অধীন পূর্ত কাজ শুরু করা যায়নি। সম্প্রতি পূর্বাচলে ৩ দশমিক ৩৩ একর জমি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরপর পূর্ত কাজ শুরুর আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, ২০১৬ সালের জুনে সাবেক মহাপরিচালক অবসরে চলে যাওয়ার পর থেমে গেছে তদন্ত কার্যক্রম। খসড়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। রহস্যজনক কারণে কমিটির সদস্যরা পিডিকে রক্ষা করতে তারা মরিয়া ছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল প্রতিবেদন তৈরি করে আহ্বায়কের কাছে জমা দেয়া। আমি আমার কাজ শেষ করেছিলাম। এরপর বদলি হওয়ায় এ সম্পর্কে তেমন কিছু আর জানি না। কাউকে বাঁচিয়ে দেয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।’ আর আহ্বায়ক অধ্যাপক হুদা বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে কোনো প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। বরং ডিজি ম্যাডামের মৌখিক নির্দেশে তখন কাজ স্থগিত করা হয়েছিল।’

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/13/139132/