১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে আংশিক ক্ষতি হয়েছে ফরিদা বেগমের বাড়িটি। রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার এক নম্বর বেতবুনিয়া ইউনিয়নের বেতবুনিয়া বাজার দক্ষিণ পাড়া থেকে ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা ছবি। সুপ্রিয় চাকমা
১৩ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৭

ধ্বংসের পাহাড় ঠেলে বেঁচে ওঠার লড়াই

কুমিল্লার মুরাদনগরে ছিল বাড়ি। ঘরে ছিল অভাবের হানা। জীবন বাঁচানো দায়। আট বছরের ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে ফরিদা বেগম ঘরের মায়া ছাড়লেন।
শিকড় গাড়লেন রাঙামাটির বেতবুনিয়ার এই দক্ষিণ বাজার পাড়া গ্রামে। সেটাই হলো তাঁর নতুন ঠিকানা। তারপর একে একে কেটে গেল ৪৫ বছর। সেই ফরিদার বয়স এখন ৬৭ বছর।
ফরিদা আসার আগে এ গ্রামে থিতু হয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই আসকর আলী। তাঁর কাছেই খবর পেয়েছিলেন, এ তল্লাটে অনেক ফাঁকা জমি, গাছগাছালি আর বাঁশ অফুরন্ত। এখানে এলে অভাব হবে না। সেই সুদিনের আশাতেই এখানে আসা। ভাইয়ের হাতছানিতে চলে এলেন ফরিদাও। তারপর কেটে গেছে অনেক দিন। স্বামীর চিকিৎসার জন্য মুরাদনগরের এক খণ্ড জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখানে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাকে কিছু অর্থ দিয়ে পেয়েছিলেন জায়গাটুকু। স্বামী মারা গেছেন। এক ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে একটু একটু করে রাঙামাটির কাউখালি উপজেলার এ গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন সংসার। শনের ঘর থেকে বাঁশের ঘর, এরপর মাটিরটা হলো। ছেলে মোহাম্মদ হানিফ বড় হয়ে রোজগেরে হলেন। কখনো দিনমজুরি, কখনোবা ছোট ব্যবসা করেন। মা-ছেলে মিলে কাজ করে সেমিপাকা বাড়িটি গড়েছিলেন। নিজেদের জমানো সবটা অর্থে কুলায়নি, বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। বাড়িটি গড়েছিলেন বলতে হচ্ছে। কারণ এখন যেটুকু আছে, তা আর বাসের উপযোগী নয়। তিনটি ঘর ছিল, এখন একটির অর্ধেক কাঠামো আছে। গত ১৩ জুনের পাহাড়ধস দরিদ্র এই পরিবারের সাধের বাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে।
ফরিদা বলছিলেন, ‘ভালা থাকিবার লাগি আসিছিলাম। এখন আর বাঁচিবার উপায় নাই, বাবাজি!’
বেতবুনিয়া বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ বাজার পাড়া গ্রাম। মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে বাম দিকের পাহাড়ের নিচে ফরিদার বাড়ি। গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে যখন সেখানে গেলাম তখন সেই ভাঙাচোড়া বাড়িটি মেরামতের কাজ করছিলেন ফরিদার ভাই ও এলাকার স্থানীয় দুজন। বাড়িটির ওপরের পাহাড়ে ধসের চিহ্ন। ওপরে থাকা বাঁশঝাড় ধসে এসে পড়েছে বাড়িটিতে। মাটিসুদ্ধ বাঁশের মোথাগুলো পড়ে আছে।
সে রাতের কথা বললেন ফরিদা। এ বাড়িতে তখন ছেলে, নাতনি ও তাঁর জামাইসহ ছয়জন ছিলেন। প্রবল বর্ষণ তখন। রাত দুইটার দিকে নাতজামাই সবাইকে ডেকে ওঠান। পাহাড় ভেঙে পড়ার ঘটনা টের পেয়েছিলেন তিনি। তারা ঘর থেকে বের হতে না হতেই দড়াম করে পাহাড়ের অংশ বাড়িটির ওপরে পরে। তবে এ পরিবারের ভাগ্য ভালো, কেউ হতাহত হয়নি। ফরিদা অবশ্য বললেন, ‘মরণের কিছু বাকি নাই। এ ঘর ক্যামনে তুলতাম?’ তিনি বলেন আর কাঁদেন।
এ কান্না পাহাড়ের সবখানেই। আর এ অবস্থাতেই একটি মাস পেরিয়ে এলেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার এক মাস পূর্ণ হবে ভয়াবহ সেই দুর্যোগের।
ফরিদা বেগমের পরিবার এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা হিসেবে পেয়েছেন ৪০ হাজার টাকা। তবে এ দিয়ে সেই বাড়িতো হবে না। এরপর আছে ঋণের বোঝা। সবকিছু মিলিয়ে দুশ্চিন্তার পাহাড় তাঁর মাথায়।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের হিসাব, এই কাউখালি উপজেলায় ফরিদার মতো এমন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১৮ হাজার। জুনের পাহাড়ধসে এ উপজেলায় মারা গেছেন ২১ জন। রাঙামাটির শহরের পর এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শহরে সেনাসদস্যসহ নিহত ৭৩। পুরো জেলায় ১২০।
‘এহানে থাকতে ভালো লাগে না, বাড়িতে ভয় লাগে’
পাহাড়ধসে রাঙামাটি সদরে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরে এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে খোলা হয়েছিল ১৯টি কেন্দ্র। বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে এসব কেন্দ্র খোলা হয়। এখন আছে ১৪টি কেন্দ্র।
রাঙামাটিতে ঢোকার মুখে রাঙাপানি এলাকায় মনঘর নামের একটি প্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র। এর একটি বৌদ্ধ ভাবনা কেন্দ্র। এখানে আছে ৬৮টি পরিবার। সবাই আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। এর মধ্যে আছে বাঙালি তিনটি পরিবার। অন্যরা পাহাড়ি। গত মঙ্গলবার শেষ বিকেলে যখন ভাবনা কেন্দ্রে ঢুকছি তখন সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর ত্রাণবাহী গাড়িটি। প্রতি দুই বেলা বাজার দিয়ে যান সেনাসদস্যরা। এখানে রান্না হয়। ১৩ জুনের পর দু-এক দিন অন্য একটি প্রতিষ্ঠান দুবেলা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াতো এখানকার আশ্রিত ব্যক্তিদের। পরে পাহাড়িরা নিজেদের খাবার নিজেরাই করে খেতে চান। এরপর সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই ব্যবস্থা হয়।
এই ভাবনা কেন্দ্রের একজন জ্ঞানপ্রিয় চাকমা বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। তাদের বাজারের তালিকায় পাহাড়িদের প্রিয় শুঁটকি, নাপ্পিও (শুঁটকির চূর্ণ) থাকে।’
এখানে দুবেলা বাজার দিয়ে যায়। সকালে শুধু শিশুদের জন্য নাশতা থাকে। বড়রা নিজেদের সামর্থ্যমতো কিনে খান খাবার। এখানে যারা আছেন তাদের সবার জন্য এভাবে আশ্রয় নিয়ে থাকা বিরল অভিজ্ঞতা। তানুভিম চাকমা (৭০) বললেন, ‘কখনো যে এ অবস্থাতে পড়ব তা ভাবিনি। মনে হয় এক যুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা।’ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাঁচজন কোনোমতে বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলেন। তবে বাড়িটি এখন কাঠামো সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রায় এক মাস হতে চলল। এটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাধনার জায়গা। সেখানে এভাবে থাকতে মন চায় না। তবে কোথায় যাবেন, এমন ভাবনা যখন মাথায় আসে তখন কোনো দিশা পান না জয়া চাকমা। রাঙাপানি মধ্যপাড়ার বাসিন্দা এ নারীর বাড়িটি এখন মাটিতে মিশে আছে। পাশের খাঁড়া পাহাড় ভয়াল মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের বাড়িটি তবুও দেখতে যান মাঝেমধ্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হন বারবারই। বললেন, ‘এখানে থাকতে ভালো লাগে না। কিন্তু বাড়িতে তো ভয় লাগে। সেখানে তো থাকব কী করে?’
এখানেই সন্ধান মেলে তিন বছরের রাজ্জুনি চাকমার। বাবা উজ্জ্বল কান্তি¯চাকমা ও রাজ্জুনি মাটিচাপা পড়েছিলেন। উজ্জ্বল কান্তি বললেন, ‘মেয়েটির মুখও ঢেকে ছিল। আমি মাটিচাপা পড়ার পর মেয়েটিকে খুঁজতেছিলাম। তাড়াতাড়ি মুখ থেকে মাটি সরায়ে ফেলি। ওর সারা শরীর মাটিতে তখন। এরপর তাকে তোলা হয়।’ শিশুটি বেশ প্রাণবন্ত। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার কথা বললে মুখ তার মলিন হয়, জানান মা শেফালি চাকমা।
এভাবে আর কত দিন?
ঈদের পর থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে রাবেয়া বেগমের দুই মেয়ে। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, আরেকজন বালিকা বিদ্যালয়ে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও লেখাপড়া চলছে। আর এভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। তবু তারা নিরুপায়। রাঙামাটি সরকারি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে স্কুল বেশ খানিকটা দূর। কিন্তু বাড়ি যাবে তারও উপায় নেই। এক মাস হয়ে যাচ্ছে, এক অনিশ্চিত যাত্রা তাঁদের। রাবেয়া বলছিলেন, ‘মাটি ছাড়া ঘর বলতে কিছু নেই। কিন্তু এভাবে দিন চলে। এভাবে আর কত দিন?’
জেলা ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র কমিয়ে পাঁচটি জায়গায় সবাইকে নিয়ে যাওয়া। সেই অনুসারে গতকাল মঙ্গলবার জেলা প্রশাসন পাঁচটি জায়গায় জেলার জিমনেসিয়ামসহ পাঁচ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আজ বুধবার থেকে কার্যকর করার কথা থাকলেও আজ বিকেল পর্যন্ত কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
তবে এভাবে এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকা আপত্তি আছে অনেকের। গতকাল বিকেলে মনঘর ভাবনা কেন্দ্রে জড়ো হওয়া আশ্রিতদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেই তারা তাঁদের উদ্বেগের কথা জানান।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বললেন, শুরুতে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের সংখ্যা ৩৬ হাজারের কিছু বেশি ছিল। এখন এ সংখ্যা দুই হাজার এক শ জনের মতো। অনেকেই রাতে এখানে থাকেন না। তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজসহ সরকারি নানা দপ্তরে কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় এখন পাঁচ জায়গায় নেওয়া হচ্ছে আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। এর ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের শনাক্ত করাও সহজ হবে।’
তবে সেই আশ্রয় কেন্দ্রেও বা কত দিন থাকবে মানুষ? জবাবে প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বললেন, ‘দুর্যোগের যে ধরন তাতে খানিকটা সময় লাগবে।’
ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে
রাঙামাটির বেশ খানিকটা দূরে সাপছড়ি খামারবাড়ি। রাঙামাটিতে আসার পথ এটি। গতকাল মঙ্গলবার জায়গাটি দিয়ে আসতে চোখে পড়ে, রাস্তার অর্ধেকেরও বেশি অংশ ধসে পড়েছে। সেখানে শ্রমিকদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। আছে সড়ক বিভাগের সতর্ক বার্তা।
১৩ জুনের পর রাঙামাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো দেশ থেকে। পাহাড়ধসে এই সড়কটিও বিধ্বস্ত হয়। ঢাকা থেকে রাঙামাটি এখন বড় যানবাহনগুলো ঘাগড়া পর্যন্ত আসতে পারছে। সেখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের রাঙামাটি শহরে আসতে এখন অবলম্বন অটোরিকশা। সড়কগুলোর মধ্যে রাঙামাটি-আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কটিতে হালকা যান চলছে। রাঙামাটি-ঘাগড়া-কাপ্তাইয়ে হালকা যান ভরসা। আর রাঙামাটি থেকে মহালছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ির রাস্তাটি চালু হয়নি এখনো।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1249711/