১৩ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৩

খাল হারিয়ে একটু বৃষ্টিতেই ডুবছে ঢাকা

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেনে প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। তাঁর মতে, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসার নয়, এ দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু সেটি তারা করছে না। দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার ও পুনঃখননের কাজও হচ্ছে না। সেসব কারণেই ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যাচ্ছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আরিফুজ্জামান তুহিন

প্রশ্ন : জলাবদ্ধতা দেখভাল করার মূল সংস্থা কারা?
ম. ইনামুল হক : ঢাকায় জলাবদ্ধতা হলে সবাই ওয়াসার দিকে আঙুল তুলছে, তাকে দায়ী করছে। বলা হচ্ছে, ওয়াসা জলাবদ্ধতা দূর করতে পারছে না। কিন্তু আইন অনুযায়ী এ দায়িত্ব তাদের নয়। এর মূল দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ ৫৯ অনুযায়ী এর আগে জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল পাউবোর হাতে। এরপর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০ করা হয়েছে। এ আইনে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে দায়িত্বটি। সেখানে বলা হয়েছে, সারা দেশের নদী, নদী অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারাজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপরই ন্যস্ত।
প্রশ্ন : এই আইন অনুযায়ী কি ঢাকার মতো শহরগুলোর জলাবদ্ধতা বা পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর বর্তায় শুধু?
ম. ইনামুল হক : কিছু দায়িত্ব ওয়াসার আছে, সেটি খুবই সীমিত। যেমন আইন অনুযায়ী এক হাজার হেক্টর এলাকার পানি নিষ্কাশন স্থানীয় সরকারের অধীন সংস্থা বা ওয়াসা করতে পারবে। কিন্তু এক হাজার হেক্টরের ওপরে হলে ওয়াসা কিন্তু পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব নিতে পারবে না, তখন এটি করতে হবে পাউবোকে।
প্রশ্ন : তাহলে ওয়াসা কেন এই দায়িত্ব নিচ্ছে? নাকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সক্ষমতা নেই?
ম. ইনামুল হক : পানি উন্নয়ন বোর্ড কেন দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে সেটি একমাত্র তারাই ভালো বলতে পারবে। তাদেরকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। আর সক্ষমতার প্রশ্নটি ঠিক উল্টো। ওয়াসারই বরং পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা নেই, যা আছে পাউবোর। ঢাকা নগরীর পশ্চিম পাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের এবং পূর্ব পাশে প্রস্তাবিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পটিও তাদের অধীনে। আর আইন অনুযায়ী গোটা ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব কিন্তু তাদের। ঢাকায় পান্থপথে যে অফিসটি আছে সেখানে প্রচুর জনবল, তারা এটি অনায়াসেই করতে পারে। আসলে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বলেই তারা হাওয়া খেয়ে সময় পার করছে।
প্রশ্ন : জলাবদ্ধতার কারণ কী?
ম. ইনামুল হক : ঢাকা শহরের মধ্যে বেশ কিছু বক্স কালভার্ট আছে। এসব কালভার্টে ওয়াসার ড্রেন থেকে সরাসরি ময়লা এসে পড়ছে। নিয়ম হলো, বক্স কালভার্টে আসার আগে পানির মধ্যে কোনো ধরনের ময়লা থাকলে, মানে পলিথিন বা অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা সরিয়ে নিতে হবে। এরপর তা বক্স কালভার্ট হয়ে খাল দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে বক্স কালভার্টে নানা ধরনের আবর্জনাসহ পানি আসছে। এ ময়লা জমে জমে কালভার্টগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার বিদ্যমান খালগুলোও সংস্কার করা হচ্ছে না। বহু জায়গায় প্রভাবশালীরা খাল দখল করে বসে আছে। ফলে যখন পানির চাপ বাড়ছে তখন কিন্তু না বক্স কালভার্ট, না খাল কোনোটিই পানি ধারণ করতে পারছে না। সে কারণেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
প্রশ্ন : ওয়াসার অধীনে থাকা ড্রেনগুলো কি পরিষ্কার হয়? আবার সিটি করপোরেশনও কি বর্জ্য ঠিকমতো সরায়?
ম ইনামুল হক : ঠিক বলেছেন। ওয়াসার অধীনে থাকা ড্রেন পরিষ্কার হয় না। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণভাবে ঢাকার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। তবে এ পরিস্থিতির জন্য শুধু ঢাকা ওয়াসা একাই নয়, সিটি করপোরেশনও দায়ী। কারণ আন্ডারগ্রাউন্ডের ড্রেনেজগুলো ঢাকা ওয়াসার আর সারফেস ও খোলা ড্রেনগুলো দুই সিটি করপোরেশনের। ওয়াসা তাদের অধীনে থাকা ড্রেনগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারছে না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন যদি ৯০ শতাংশ বর্জ্যও ঠিকমতো সরাতে পারত, তাহলে বৃষ্টির পানির সঙ্গে বর্জ্য মিশে ড্রেন বন্ধ হতো না।
প্রশ্ন : তাহলে কি ওয়াসা, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে?
ম ইনামুল হক : ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নয় পানি নিষ্কাশনের। আমি আগেই বলেছি, মূল দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সক্ষমতা আছে পানি নিষ্কাশনের। আর সমন্বয়ের দরকার নেই। দরকার হলো দায়িত্ব যার, তারই পালন করা। তবে বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাদের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে হবে। কোনোভাবেই যেন বর্জ্য গিয়ে ড্রেনের মধ্যে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন : পৃথিবীর সব দেশেই বৃষ্টি হলে মূল সড়কে পানি জমে। বাংলাদেশেও জমছে। তাহলে এত সমালোচনা কেন?
ম ইনামুল হক : ভালো প্রশ্ন। অতিবৃষ্টির কারণে কমবেশি উন্নত বিশ্বেও শহরের রাস্তায় পানি জমে; কিন্তু তা কত সময়ের জন্য? বৃষ্টি থামার কিছুক্ষণ পরই পানি নেমে যায়। কারণ তাদের ড্রেনেজ সিস্টেম ওই ভারি বর্ষণের পানি প্রবাহ করতে সক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশে বৃষ্টি হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় পানি জমে থাকে। এ পরিস্থিতি পৃথিবীর কোনো রাজধানী শহরে আছে বলে আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : জলাবদ্ধতা দূর করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি?
ম ইনামুল হক : ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তার কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা বা রাজউকের এ ক্ষমতাও নেই, আইনও নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে খালের খাসজমি উদ্ধার করতে হবে। এ কাজে সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সহায়তা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে যে অবস্থা দেখছি তাতে সন্দেহ হয় এ নগরীর দুজন নগরপিতা আদৌ নগরবাসীর সমস্যা নিয়ে ভাবেন কি না। সবার আগে দরকার খালগুলোকে উদ্ধার করা। এসব খাল উদ্ধার করে এলাকাভিত্তিক নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত এবং ডিজাইন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তা খনন করতে হবে। পাউবো প্রয়োজনে নতুন জমি হুকুমদখল করে ব্যাংকক নগরীর মতো খোলা নিষ্কাশন খাল নির্মাণ করবে। এতে জলাবদ্ধতা একেবারেই থাকবেই না।
প্রশ্ন : খাল অবমুক্ত করা যাচ্ছে না কেন?
ম ইনামুল হক : একসময় ঢাকার ভেতর দিয়ে মানুষ নৌকায় যাতায়াত করত। এটিকে কিন্তু ভেনিসের আদলে গড়ে তোলা যেত। অপরূপ শহর হতো এটি। ঢাকার ৪৪টি নিষ্কাশন খাল দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সিএস ম্যাপে এসব খাল খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এগুলো মোটেও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি নয়। প্রভাবশালীরা জাল দলিলে আরএস ম্যাপে সেসব ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এসব দেখেও দেখেননি। ফলে সারা নগরী নিষ্কাশন খালহীন জনাকীর্ণ বস্তিতে পরিণত হয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/13/518582