ফাইল ছবি
১৩ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৩১

রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

 

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে খোলা আকাশের নিচে হাজার কোটি টাকার পণ্য পড়ে আছে। বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে আমদানিকৃত এসব পণ্য নষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেখান থেকে পণ্য চুরির ঘটনাও ঘটছে। আমদানি পণ্য নষ্ট হওয়ায় বাংলাদেশ বিমানের উদাসীনতা ও অবহেলাকেই দায়ী করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য বার বার অনুরোধ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।


সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারক সূত্রে জানা যায়, বিমানের লোডাররা ইচ্ছা করে এলোমেলোভাবে আমদানি করা পণ্য রাখেন। এতে এক মাস আগে আসা পণ্যও খুঁজে পাওয়া যায় না। সঠিক সময়ে পণ্য হাতে না পাওয়ায় অনেক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান রফতানির আদেশ বাতিল করতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া খোলা আকাশের নিচে পণ্য পড়ে থাকায় একটি চক্র কার্টন ভেঙে ও পলিথিন খুলে পণ্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে গার্মেন্টস এক্সেসরিস, মোবাইল ফোন থেকে নানা ধরনের পণ্য চুরি হচ্ছে। এতে আমদানিকারকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। গত বর্ষায়ও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ী নেতারা বিষয়টি সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তখন উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হলেও চলতি বর্ষায়ও ফের একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।


বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, বর্ষায় এ ধরনের সমস্যা প্রকট হয়। আমাদের কার্গো পণ্য বেড়েছে। অথচ স্থান সংকট রয়েছে। পণ্য রাখার এলাকা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। দ্রুত অনেকগুলো শেড নির্মাণ করা হবে।


বিমানের কার্গো শাখা সূত্রে জানা যায়, কার্গো আউট ইয়ার্ডের সর্বমোট আয়তন এক হাজার ৭০০ বর্গফুট। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এখান থেকে ১০০০ বর্গফুট নিয়ে নিয়েছে। তাই এখন কার্গো রাখার জন্য আউট ইয়ার্ডে মাত্র ৭০০ বর্গফুট জায়গা আছে বিমানের। এ কারণে দুই থেকে তিনটি ফ্লাইট নামলেই ভয়াবহ কার্গো জট দেখা দেয়। কোনো প্রতিষ্ঠান দুই কার্টনে পণ্য আমদানি করলে একটি পাওয়া যায় মাঠের এক প্রান্তে, অন্যটি থাকে মাঠের অপর প্রান্তে। পণ্যের খোঁজে বিভিন্ন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান, ফার্মাসিউটিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির কর্মকর্তা ও তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা প্রতিনিয়ত গলদঘর্ম হন। এ অবস্থার কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির মতো দেশ বিমানে সরাসরি পণ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে।


১ জুন থেকে ইইউভুক্ত দেশগুলোয় কার্গোতে পণ্য পাঠাতে এক্সপ্লোসিভ ডিটাকশন সিস্টেমের (এলইডিএস) আওতায় স্ক্যানিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়। জানা যায়, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন ও বিমানকে দেওয়া চিঠিতে ইইউ বলেছে, বিমানের কার্গো টার্মিনাল বহিরাগত জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। পণ্য স্ক্যানিংয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলা রয়েছে।


আমদানিকারকদের অভিযোগ, বিমানের ফ্লাইট অফিসারের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী পণ্য নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার দায়িত্ব বিমানের লোডারদের। বন্ডেড ও ওয়্যারহাউসে এসব পণ্য থরে থরে সাজানো থাকার কথা। কাস্টমস ডিউটি ও গুদাম ভাড়া পরিশোধের পর ডেলিভারির জন্য পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে বাড়তি টাকার জন্য লোডাররা ইচ্ছা করে পণ্যগুলো এলোমেলো করে রাখেন। বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, ওয়্যারহাউসে র্যাক থাকলেও তাতে প্লেট নেই। ফলে মালপত্র রাখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে পণ্য ফেলে রাখা হচ্ছে।


জানা যায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০টি কার্গো ফ্লাইট ওঠানামা করে। ফ্লাইট নামার সঙ্গে সঙ্গে বিমান কর্তৃপক্ষের অ্যারোবিল অনুযায়ী মালপত্র গোডাউনে সংরক্ষণ করার কথা। এর পর অ্যারো বিল দেখিয়ে আমদানিকারক ও তাদের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শুল্কায়ন শেষে মালপত্র নিয়ে নেবে। কিন্তু এ নিয়মও মানা হয় না। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধিরা মালপত্র ঢাকায় পেঁৗছার এয়ারঅ্যারো বিলের কপি হাতে নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিমানের ইমপোর্ট কার্গো কমপ্লেক্সের বারান্দায় ঘুরলেও পণ্যের হদিস পাচ্ছেন না। বিমান কর্তৃপক্ষের দাবি, খুঁজে না পওয়া সব পণ্যই শাহজালালের রানওয়ে সংলগ্ন 'বে' এরিয়ায় উন্মুক্ত স্থানে রাখা হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের নির্দেশে সেখানে মালপত্র রাখা হচ্ছে। এদিকে কার্গো ওয়্যারহাউস-১ ও ২-এর নির্মাণ কাজ দুই বছর আগে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। এ কারণে কার্গো ওয়্যারহাউস ছাড়িয়ে মালপত্রের স্তূপ চলে গেছে বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর বে-এলাকা পর্যন্ত।


আতিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের ম্যানেজার শফিকুর রহমান বলেন, পণ্যসামগ্রী খোলা আকাশের নিচে থাকলেও গোডাউন চার্জ দিতে হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় পণ্য শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য বার বার আবেদন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।


ঢাকা সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি এমএ মান্নান সমকালকে বলেন, বিমান কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এমনটি হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরাও এ নিয়ে চরম বিপদে রয়েছেন।


ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কাপড়ের রঙ জলে গেছে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধানে তিনি এবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।


বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, কার্গো পণ্য বেড়ে যাওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি সমাধানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এরই মধ্যে বড় বড় শেড তৈরি করে সেখানে মালপত্র রাখার জন্য তাক তৈরি করা হচ্ছে।

 

http://bangla.samakal.net/2017/07/13/307668