২১ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১৩

গাজীপুরে শিল্প-কারখানায় ভয়াবহ গ্যাস সংকট

শত শত শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত, রফতানি আদেশ বাতিল হওয়ার আশংকা * কর্তৃপক্ষের কথার সঙ্গে বাস্তবে কাজের কোনো মিল নেই * শফিপুর, কোনাবাড়ি, সিনাবোহতে গ্যাসের চাপ কম

গাজীপুর শফিপুর, কোনাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকার শিল্প-কারখানায় ভয়াবহ গ্যাস সংকট চলছে। গ্যাসের অভাবে দিনের বেশির ভাগ সময়ই এসব এলাকার শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনে চরম বিঘœ ঘটছে। এভাবে লাভ তো দূরের কথা রফতানিমুখী বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে লোকসানের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় শিল্পমালিকদের অভিযোগ, কিছু দিন পরপর শিল্পাঞ্চল হিসাবে খ্যাত এই এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উদ্বেগ, চিঠি চালাচালি হলেও নির্বিকার সরকার। সংকট নিরসনে খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব একাধিকবার ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু কিছুতেই সমাধান মিলছে না। অথচ সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে প্রায় বলা হয়, দেশে শিল্প বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিদ্যমান।
এদিকে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মশিউর রহমানও যেন অনেকটা নিরুপায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি যুগান্তরকে বলেন, গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে গাজীপুর এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ওই এলাকায় কয়েক দিন ধরে গ্যাসের চাপ কমে গিয়েছিল। তিনি এজন্য শিল্পমালিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে শুক্রবারের (আজ) মধ্যে সংকট সমাধান হয়ে যাবে বলে জানান। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে গ্যাসের উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। পাশাপাাশি সার ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেও গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই গ্যাস থেকে গাজীপুরসহ আশপাশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে সরবরাহ করা হবে।
ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস না পেয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় কারখানাগুলোয় পণ্যের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, রফতানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোয় এ সংকট এখন চরমে রূপ নেয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন শিল্প-কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৫ দিন ধরে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এতে কারখানার উৎপাদন ব্যাহতের পাশাপাশি খরচও বাড়ছে অনেক। প্রয়োজনীয় গ্যাস না থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় জেনারেটর ও বয়লারের মতো যন্ত্রপাতির বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল বা তেল ব্যবহার করতে হয়। এতে গ্যাসের তুলনায় খরচ পড়ে দ্বিগুণ। ভারি শিল্প-কারখানাগুলোকে একই ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
কোনাবাড়ী, শফিপুর ও সিনাবোহ এলাকার কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ১০-১৫ দিন যাবত এই গ্যাস সংকট চলছে। সন্ধ্যার পর সীমিত আকারে কিছু কিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ পাওয়া গেলেও সারা দিন থাকে শূন্য। এর ফলে কোনো কোনো কারখানার একটি ইউনিট কোনোমতে চালানো সম্ভব হলেও গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় পুরোপুরি উৎপাদনে যাওয়া যাচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে শুধু শিল্প-কারখানার মালিক নন, এলাকার সিএনজি স্টেশন ও বাসাবাড়িতেও গ্যাসের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সিএনজি স্টেশনে গত কয়েক দিন ধরে দীর্ঘ লাইন হয়ে যাচ্ছে। সেখানেও গ্যাসের চাপ নেই। বহু এলাকা থেকে খবর আসছে, তাদের চুলাও জ্বলছে না।
ভুক্তভোগী শিল্পমালিকদের অনেকেই জানিয়েছেন, উৎপাদনের মৌসুমে এভাবে গ্যাস সরবরাহ বিঘিœত হলে তাদের রফতানি আদেশের বেশির ভাগ বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষতি কোনোভাবে পোষানো যাবে না।
শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ- সাভার, গাজীপুর, শফিপুর, সিনাবোহ, কোনাবাড়ী এলাকার শিল্প-কারখানাগুলো কয়েক বছর ধরেই গ্যাস সংকটে ভুগছে। গ্যাস স্বল্পতায় তারা অনেক সময়ই কারখানা চালু রাখতে পারেন না। কিন্তু গত পাঁচ দিন থেকে এ সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ছোট ও মাঝারি মানের অধিকাংশ কারখানাই গ্যাসের অভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গাজীপুরের কোনাবাড়ী বিসিক শিল্প এলাকার নাইটিঙ্গেল গ্রুপের কারখানা ব্যবস্থাপক টিএম হুমায়ূন কবির জুয়েল জানান, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৫টা পর্যন্ত গ্যাসের প্রেসার একেবারেই কমে যায়। এ সময় যে প্রেসার থাকে, তা দিয়ে কোনো মেশিন চালানো সম্ভব নয়। তখন ডিজেল মেশিন ব্যবহার করতে হয় বিকল্প হিসেবে। এতে খরচ বাড়ে ৩-৪ গুণ। সাধারণত জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য পোশাক কারখানাগুলোয় ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু সকালে তা ২-৩ পিএসআইয়ে নেমে আসে, যা দিয়ে কোনোভাবেই গ্যাসচালিত মেশিন চালানো সম্ভব নয়। বিকালের দিক থেকে চাপ কিছুটা বেড়ে রাতনাগাদ তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় অনেক কারখানায় রাতের শিফট চলে না। ফলে পোশাক কারখানায় ‘পিক আওয়ারে’ গ্যাস সংকট সার্বিক উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
এ ব্যাপারে তিতাসের গাজীপুর অফিসের ম্যানেজার সুরুজ আলম যুগান্তরকে বলেন, তারা তিতাসের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না। এ কারণে দিনে গ্যাসের চাপ থাকে না। তিনি বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন বিদ্যুৎ ও সার কারখানা চালু থাকায় ওইসব কারখানায় অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে গাজীপুর এলাকায় এ সংকট দেখা দিয়েছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/21/141516/