২১ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৫

থামছে না মাদকের আগ্রাসন

প্রতিদিন ইয়াবা আসছে ৩০ লাখ পিচ : মায়ানমারে পাচার হচ্ছে ১৩ হাজার কোটি টাকা

মায়ানমান থেকে প্রতিদিন ৩০ লক্ষাধিক পিচ ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে। বিনিময়ে বছরে পাচার হচ্ছে কমপক্ষে ১৩ হাজার কোটি টাকা। ভারত থেকে প্রতি বছর থেকে মাদক আসছে ১০ হাজার কোটি টাকার। দেশজুড়ে ইয়াবা আসক্তদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন মাদক বাবদ সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে মায়ানমারে। প্রতিদিন মায়ানমার থেকে বিভিন্ন চোরাচালান পথে ৩০ লক্ষাধিক পিচ ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা গেছে। সে হিসেবে শুধু ইয়াবা বাবদ প্রতি বছর মায়ানমারে কমপক্ষে ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে থাকে। মাদক আমদানি, বেচাকেনা, চোরাচালান, মাদক নিরাময় কেন্দ্রসমূহের বেপরোয়া বাণিজ্য, মাদক প্রতিরোধের নামে আড়াই শতাধিক এনজিও’র বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বছরব্যাপী নানা অভিযান, মামলা পরিচালনাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে বছরে লেনদেন হচ্ছে কমপক্ষে ৬০ হাজার কোটি টাকা। মাদক প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান চলছে। সক্রিয় আছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তারপরেও মাদকের আগ্রাসন থামানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদক মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে। বিশেষ করে ইয়াবা সেবনকারীদের নার্ভগুলো এক থেকে দুই বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়। ইয়াবা মানুষের ক্ষুধা নষ্ট করে , খাবারে অরুচি আনে, যাতে মারাত্মক অপুষ্টি সৃষ্টি এবং শরীরের ইলেক্ট্রোালাইট ব্যালান্স নষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইয়াবা সেবনকারীরা মানসিক রোগে ভুগতে থাকে। অস্থির ভাব এবং তারা যেকোন সময় অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। বেশিরভাগ ইয়াবা আসক্ত সিজেফ্রেনিয়ার মানসিক রোগের শিকার হয়।
আইসিডিডিআরবি’র এক সমীক্ষায় বলা হয়, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদক ব্যবহারজনিত ব্যয় বছরে ৫৬ হাজার ৫৬০ টাকা থেকে ৯০ হাজার ৮শ’ টাকা পর্যন্ত। সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ হলে বছরে এই খাতে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এর সঙ্গে মাদক নিরাময় কেন্দ্র, এনজিও কার্যক্রম ও সরকারি কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে আরো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। তবে গোয়েন্দাদে পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির বার্ষিক গড় ব্যয় আড়াই লাখ টাকা। একটিভ টুয়েন্টি-ফোরটি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন মাদক জরিপের তথ্যানুযায়ী ২০০২ সালেও বাংলাদেশে মাদকাসক্তরা বছরে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতো। এখন সে ব্যয়ের পরিমাণ পাঁচ গুণ ছাড়িয়ে গেছে।
আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর শুধু ভারত থেকেই অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার মাদক আমদানি হয়ে থাকে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি বছর ভারত থেকে শুধু ফেন্সিডিলই আসে ৩০৪৭ কোটি টাকার।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ মাদকাসক্ত হওয়ায় তাদের ঘিরে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে। মাদক সরবরাহ, ভেজাল মাদক তৈরি, পুলিশের ধরা ছাড়া বাণিজ্য, মাদক বিরোধী সামাজিক কর্মকান্ড চালানোসহ বিভিন্ন কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। মাদকাসক্ত নিরাময়ের নামেও একাধিক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ ওইসব কেন্দ্রের অধিকাংশের বৈধ কোনো অনুমোদন নেই, নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। এসব স্থান থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসার নজিরও নেই। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আখ্যায়িত করে কেউ কেউ সমাজসেবা অধিদফতর, ঢাকা সিটি করপোরেশন বা মানবাধিকার সংগঠন থেকে অনুমোদন নিয়েই প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে মাদক নিরাময়ের নামে এমন ১২ শতাধিক প্রতিষ্ঠান অভিনব বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। চিকিৎসার নামে মাদকাসক্তকে মাসের পর মাস আটক রেখে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এমন অমানবিকতার পরও বিল বাবদ হাতিয়ে নেয়া হয় ৪০/৫০ হাজার টাকা। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে হাত-পা বাধা, সারাদেহ থেতলানো অবস্থায় লাশ উদ্ধারের নজিরও আছে। কিন্তু তারপরেও বেআইনী এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, ঢাকায় এখন অনুমোদিত মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৮টি। আরও ১০/১৫টি নিরাময় কেন্দ্রের আবেদন জমা আছে। মুকুল চাকমা বলেন, নিরাময় কেন্দ্র অনুমোদনের বিষয়ে এখন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আগে যেভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল তাতে অনেক বদনাম হয়েছে। আমরা এখন ভেবে-চিন্তে ন্যুনতম যোগ্যতা না থাকলে কোনো অনুমোদন দিচ্ছি না। তবে তিনি স্বীকার করেন ঢাকার অলি-গলিতে অনুমোদন ছাড়া সাইনবোর্ডবিহীন বহু নিরাময় কেন্দ্র আছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি প্রতি বছর যে পরিমাণ মাদক দেশে প্রবেশ করে তার শতকরা ৩০ ভাগ তারা উদ্ধার করেন। বাকী ৭০ ভাগ বিভিন্ন হাত ঘুরে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের হাতে চলে যায়। তবে বিভিন্ন সূত্রের দাবি, প্রতি বছর যে পরিমাণ মাদক দেশে ঢুকছে তার মাত্র শতকরা ১০ ভাগ উদ্ধার সম্ভব হয়। সূত্র মতে, দেশে এখন সবচেয়ে বেশি মাদক ইয়াবা আসছে মায়ানমার থেকে। ইয়াবা পাচার বন্ধে নাফ নদীতে মাছ ধরাও নিষিদ্ধের কথা ভাবছে সরকার। এরপরই আছে ভারতের স্থান। ভারত থেকেও আসছে মাদকের বড় বড় চালান। সূত্র জানায়, ভারত-বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ সীমান্তের ৫১২টি পয়েন্টকে মাদক আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। এসব পয়েন্টে রাত-দিন আসছে হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। বিশেষ বিশেষ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে দেশের সীমান্ত পয়েন্টসমূহে দিনমজুর শ্রেণীর ৩০/৩৫ হাজার লোক মাদক আনা নেয়ার কাজে জড়িত। সারাদেশে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরো ২৫ সহ¯্রাধিক ব্যক্তি। এরমধ্যে শুধু রাজধানীতেই ১০থেকে ১২ হাজার ব্যক্তি মাদক কেনাবেচার সাথে জড়িত। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এক লাখেরও বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ, ১৩ ভাগ নারী। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০০৩ সালেও দেশে ৫ লাখ মাদকাসক্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছিল। এখন সরকারি মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি স্বীকার করে দেশে ৬০ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক জরিপে বলা হয়, আসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। ১৫ ভাগ উচ্চ শিক্ষিত মাদকাসক্ত। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, দেশে সুঁই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যাও এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এ মাদকাসক্তরা শিরায় মাদক গ্রহণ করায় এইচআইভি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজধানীর মাদকাসক্তদের ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ ও ২০ দশমিক ৬ শতাংশ মহিলা। মাদকাসক্তদের ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশই অবিবাহিত।

https://www.dailyinqilab.com/article/88415/