রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় জলজট-যানজট (ওপরে); সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ছবিগুলো তুলেছেন আমাদের সিনিয়র আলোকচিত্রী নাসিম সিকদার
২০ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯

রাজধানীবাসী বহুমুখী সমস্যায় নাকাল

বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা। বাড়তি জনসংখ্যার চাপ, ভাঙ্গাচোরা সড়ক, খোঁড়াখুঁড়ি, যানজট, জলাবদ্ধতা, ধুলা, ফাইওভার নির্মাণ থেকে সৃষ্ট রাস্তাঘাটের সমস্যা, মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া-ডেঙ্গু রোগসহ ইত্যকার অগণন সমস্যায় নগরবাসীর জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে এসব সমস্যা নিরসনে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তাতে প্রশান্তি মিলছে না; বরং দিনকে দিন নতুন নতুন জটিলতায় নগরজীবনের সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
জনসংখ্যার চাপ : রাজধানীতে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। জরিপকারী বিভিন্ন সংস্থার মতে ঢাকার বর্তমান লোকসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখের মতো। তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেছেন রাজধানীর জনসংখ্যা আরো অনেক বেশি। এ সংখ্যা প্রায় তিন কোটি হবে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের জরিপ মতে, রাজধানীতে প্রতিদিন নতুন করে যোগ হচ্ছে ৯৫৯ জন মানুষ। পড়শোনা, চাকরি ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকায় আসার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকার আশপাশের ১৬টি ইউনিয়ন দুই সিটি করপোরেশনের সাথে যুক্ত হওয়ার পর রাজধানীর আয়তন দ্বিগুণ হয়ে বর্তমানে প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। তারপরও এত ছোট এলাকায় বিশ্বের খুব কম দেশেই এত বেশি বাস করে। ফলে বসবাস, চলাচল থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা বেড়েই চলেছে।
ভয়াবহ যানজট : যানজট রাজধানীর নিত্যদিনের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আগে শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নগরীর রাস্তা কিছুটা ফাঁকা থাকলেও বর্তমানে এ দুদিনেও মুক্তি মিলছে না। আর কর্মদিবসে প্রায় প্রতিটি সড়কেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনের চাপ লেগে থাকে। মিরপুর থেকে রাজধানীর কেন্দ্রস্থল মতিঝিল আসতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা লাগে। উত্তরা থেকে নতুন বাজার, বাড্ডা-রামপুরা হয়ে মতিঝিল আসতে তিন থেকে চার ঘণ্টাও অনেক সময় লেগে যায়। ধানমন্ডি মিরপুর রোড, কাকরাইল থেকে মগবাজার রোড, পুরানা পল্টনের চার দিকের প্রতিটি সড়ক, মহাখালী থেকে মগবাজার, মহাখালী থেকে বনানী, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা, যাত্রাবাড়ী থেকে খিলগাঁওসহ প্রতিটি সড়কেই যানজট লেগে থাকে। এতে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। রাজধানীতে যানজটের প্রধান কারণ সড়ক অবকাঠামোর তুলনায় যানবাহনের আধিক্য। অথচ সেই অবস্থায় গণমানুষের ব্যবহৃত বাস তেমন না বাড়লেও প্রতিদিন ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে তিন শতাধিক। এতে রাস্তার ব্যবহার বাড়লেও যাত্রীদের চলাচলের সুযোগ বাড়ছে না।
রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি : যানজটের আরেক কারণ বছরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। প্রতি বছর শুষ্ক মওসুমে দুই সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, ডেসকো, তিতাসসহ বিভিন্ন সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে। বলা হয়, বর্ষার আগেই কাজ শেষ হবে। নিয়মও আছে জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করার। কিন্তু এসব নিয়ম মানার কোনো বালাই নেই। বর্তমানে বর্ষাকালের অর্ধেক আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ চলছে। কিন্তু খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হয়নি। মিরপুরের শ্যাওড়াপাড়ায় দীর্ঘদিন থেকেই খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। সম্প্রতি কিছু জায়গায় মাটি-বালু দিয়ে ভরাট করা হলেও তা এখনো চলাচলের উপযুক্ত হয়নি। রামপুরা সড়কে ড্রেন নির্মাণকাজ চলছে। রামপুরা ব্রিজ থেকে হাজীপাড়া এলাকায় রাস্তার পূর্ব পাশে মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। বিজয়নগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন, শান্তিনগর, ফকিরাপুল এলাকায় ড্রেন নির্মাণ কাজ এখনো অব্যাহত। সেখানে রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ কেটে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে ড্রেন নির্মাণকাজ চলছে। এতে পথচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
জরাজীর্ণ পথঘাট : খোঁড়াখুঁড়ির পাশাপাশি মূল সড়ক থেকে অলিগলির রাস্তাঘাট পর্যন্ত ভেঙে একাকার হয়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষার পর প্রায় প্রতিটি সড়কে গর্ত তৈরি হয়েছে। কোথাও হঠাৎ দেবে গেছে সড়ক। রামপুরা থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা দীর্ঘদিন থেকেই খারাপ। বর্তমানে অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে সড়কটি। সম্প্রতি উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে কয়েক জায়গায় ইট-বালু দিয়ে ভরাট করা হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং নতুন করে আরো কিছু জায়গায় গর্ত তৈরি হয়েছে। এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী তুরাগ পরিবহনের যাত্রী শফিকুর রহমান বলেন, এ রাস্তা দিয়ে বাসে যেতে গেলেও মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে। বাসে চড়ার পর শরীরের হাড়গোড় ব্যথা হয়ে যায়। মালিবাগ রেলগেট এলাকায় ফাইওভার নির্মাণের কারণে অধিকাংশ গাড়ি মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার আবুল হোটেলের সামনে থেকে খিলগাঁওগামী বাইপাস সড়ক ব্যবহার করে। কিন্তু এ সড়কে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। কয়েকটি গর্ত পুকুরের আকার ধারণ করেছে। এ কারণে এ সড়কে রাত-দিন যানজট লেগেই থাকে। আর বৃষ্টি হলেই এ সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। তখন দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন উপলক্ষে ধানমন্ডির মিরপুর রোড থেকে কল্যাণপুর সড়কের গর্তগুলো ইট-বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। কিন্তু তাতে সড়কের চিত্র খুব বেশি বদলায়নি। এখনো সড়কে অসংখ্য গর্ত রয়েছে। এ কারণে সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করতে কষ্টের সীমা থাকে না। মগবাজার থেকে মহাখালী সড়কে উঁচু-নিচু ঢেউ তৈরি হয়েছে। তেজগাঁও লিংক রোডে অসংখ্য বড় বড় গর্ত। মতিঝিল টয়েনবি সার্কুলার রোড, টিটিপাড়া থেকে খিলগাঁও ফাইওভার সড়ক, বাসাবোর মূল সড়ক ও ওয়াসা রোড ভেঙে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বৃষ্টিতে কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভনের সামনে রাস্তা ধসে বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।
জলাবদ্ধতা : জলাবদ্ধতা রাজধানীর আরেকটি ভয়াবহ সমস্যা। আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই শান্তিনগর এলাকায় হাঁটুপানি জমে যেত। এখন অনেক সড়কেই হাঁটুপানি জমে যাচ্ছে। বিজয়নগর, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা থেকে মতিঝিল, রাজারবাগ, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, কাওরান বাজার, পান্থপথসহ আশপাশের এলাকার রাস্তা, মিরপুর-১০ থেকে শ্যাওড়াপাড়া, মিরপুর সাংবাদিক কলোনিসংলগ্ন কালসী সড়ক, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া বাইপাস সড়ক, উত্তরার প্রধান সড়ক, ৪ নম্বর সেক্টর এলাকা এর অন্যতম। খিলক্ষেতে আগে জলাবদ্ধতা ছিল না। কিন্তু এবারের বর্ষায় সেখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নিকুঞ্জ এলাকায় গত বর্ষায় বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ডিএনডি বাঁধের নাগরিকেরা প্রতি বছরই পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেখানে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৬ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অনুষ্ঠিত আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় সভায় এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাজধানীর খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ার কারণে সড়কগুলোই এখন খাল হয়ে যাচ্ছে। এক সময় ৫২টি খাল থাকলেও এখন ৯টি খালের কোনো অস্তিত্বই নেই। বাকি ৪৩টির অবস্থাও করুণ। অনেক খালের শেষ চিহ্নও নেই। এসব খালের ওপর বাড়িঘর বানানো হয়েছে। আর যেসব খাল আছে সেগুলোও ৪০-৬০ ফুটের জায়গায় আছে ৪-৭ ফুট করে। এ কারণে সভায় উপস্থিত নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন অনেকটা কৌতুক করেই পরামর্শ দেন রাজধানীর সড়কগুলো শুষ্ক মওসুমে রাস্তা আর বর্ষা মওসুমে নদী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। ঢাকার ড্রেনগুলোর অবস্থাও খুবই খারাপ। ময়লা-আবর্জনা ঢুকে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কারও করা হয় না। এ কারণে বৃষ্টি হলেই রাস্তা এখন খাল হয়ে যাচ্ছে। এতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন নগরবাসী।
এক দিকে জলাবদ্ধতা সমস্যা, অন্য দিকে দু-তিন দিন বৃষ্টি বন্ধ হলেই আবার শুরু হয় ধুলার যন্ত্রণা। বৃষ্টির সময় রাস্তায় কাদাপানি হয়ে যায়। দুই দিন রোদ হলেই সে কাদাপানি ধুলায় পরিণত হচ্ছে। এতে নগরবাসী শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
মৌচাক-মগবাজার ফাইওভার নির্মাণের কারণে পথঘাটে সৃষ্ট জটিলতায় গত চার-পাঁচ বছর ধরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি সে যন্ত্রণা। কয়েকটি পথ খুলে দেয়া হলেও এখনো মালিবাগ এলাকার রাস্তা-ফুটপাথ দিয়ে চলতে গিয়ে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
মশা-মাছির যন্ত্রণা : মশা-মাছির যন্ত্রণায় দীর্ঘদিন থেকেই ভুগছে রাজধানীবাসী। গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুতে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে। এ বছর যুক্ত হয়েছে নতুন আপদ। চিকুনগুনিয়া নামে মশাবাহিত রোগ নিয়ে এখন পুরো রাজধানী আতঙ্কগ্রস্ত। ভাইরাসজনিত এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। উচ্চমাত্রার জ্বরের সাথে শরীরের গিরায় গিরায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে মানুষ। পাঁচ-সাত দিনে জ্বর কমলেও ব্যথা থেকে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। আর জ্বরের সময় অনেকে হাঁটার শক্তিও হারিয়ে ফেলছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ জন্য দুই সিটি করপোরেশনকে দায়ী করলেও তা মানতে রাজি নয় তারা; বরং উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলে বসেন তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশারি টানিয়ে দিতে পারবেন না। এতে নগরজুড়ে তীব্র সমালোচনা হলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। উপায়ান্তর না দেখে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ফগার মেশিন নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। এলাকায় এলাকায় গিয়ে বিশেষ অভিযানের পাশাপাশি র্যালি, লিফলেট বিতরণ ও মতবিনিময় করছেন। জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজধানীতে এসব সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে বিদ্যুৎ লোডশেডিং, গ্যাস সমস্যা, পরিবেশদূষণের মতো আরো নানা যন্ত্রণা।
গত ১৬ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটিতে রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ নিয়ে এক আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় উপস্থিত প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাজধানীর দুর্ভোগ নিরসনে নতুন মাস্টারপ্লান তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। তিনি বলেন, রাজধানীতে যেভাবে সমস্যা বাড়ছে তাতে আগের কোনো পরিকল্পনায় কাজ হবে না। এ জন্য নতুন করে পরিকল্পনা নিতে হবে। একই সাথে তিনি জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল উদ্ধারসহ আনুষঙ্গিক সেবার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দেয়ার পক্ষে মত দেন। এসব হচ্ছে কেতাবি কথা। কিন্তু রাজধানীর মানুষ জানে না কবে তারা নগর জীবনের এ বহুবিধ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। শান্তি ও স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে পৃথিবীর আর দশটি উন্নত দেশের রাজধানীর মতো।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/237194