২০ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৭

বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ

যানজটে প্রতিদিন ঢাকায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট

‘সেবা সংস্থার সমন্বয় ও সিটি গভর্নমেন্ট প্রয়োজন’

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যম আয়ের ল্য অর্জনে ঢাকার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। গত ১০ বছরে যান চলাচলের গড় প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে এই হার প্রতি ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে। অথচ পায়ে হেঁটে চলার গড় গতি ৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। আর ঢাকার দুই মেয়র বলেছেন, ঢাকাকে আধুনিকায়ন করতে হলে সব সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে সিটি গভর্নমেন্টে পরিণত করতে হবে। আর এলজিআরডি মন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান পুরনো। এটাকে আধুনিক করতে হবে।
রাজধানীর এক হোটেলে ২০৩৫ সালে ঢাকার উন্নয়ন শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের দণি এশীয় প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা, ইউই লি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনায় বক্তব্য রাখেন, দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, ঢাকা উত্তর মিটির মেয়র মো: আনিসুল হক ও দক্ষিণ সিটির মেয়র মো: সাঈদ খোকন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ঢাকা মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সাথে ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। ফলে একটি বিশৃঙ্খল ও অসমনগরায়ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ অনেক অধিবাসী প্রায়ই মৌলিক সেবা, অবকাঠামো ও সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বাংলাদেশের শহরে জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বৃহত্তর ঢাকায় বাস করে। ঢাকা এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর অন্যতম। দেশটির ৫০তম জন্মবার্ষিকীর মধ্যে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে ওঠার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ঢাকার শহরায়ন সম্প্রসারণের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাবে অত্যধিক ঘনবসতি, নি¤œমানের বসবাসযোগ্যতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঢাকার রাস্তা ৫ শতাংশ, জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ এবং যান চলাচল ১৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মহানগরীর পূর্ব দিকে বেশির ভাগ এলাকা এখনো গ্রামীণ। তবে দ্রুত বিকাশ লাভের সুযোগ রয়েছে। মহানগরীর এলাকার ৪০ শতাংশের সমান পূর্ব ঢাকা। গুলশানের মতো সমৃদ্ধ এলাকার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ব ঢাকাকে নানা সুবিধাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের একটি প্রাণচঞ্চল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যা মূল শহরের অন্যান্য অংশের ভিড় ও যানজট কমাতে সহায়ক হবে।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাকে ঘিরে নেয়া সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দ্রুত এগোচ্ছে। আর ঢাকা তার চেয়েও দ্রুত এগোচ্ছে। ঢাকার আয়তন দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ ভাগ। অথচ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৬ শতাংশ আর আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ৪২ শতাংশ ঢাকার অবদান। ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক নগরবাসীর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসুবিধা, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ চ্যালেঞ্জ হবে। তবে আমাদের ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান আধুনিক করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ঢাকার আয়তন ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ১২৭ বর্গমাইল থেকে ২৭০ বর্গমাইলে উন্নীত করেছে। রাজধানীর মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা সক্রিয় আছে। উন্নত নগর গড়তে হলে পুরো শহরের স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। গণপরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট, বাস র্যাপিট ট্রান্সপোর্ট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, উড়াল সড়ক ও নদীভিত্তিক বৃত্তাকার যাতায়াত তৈরির কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিভাবে উত্তোলন করা যায় সে ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।
মেয়র আনিসুল হক বলেন, বিশ্বব্যাংক ভালো পার্টনার, কিন্তু লেইট ডিসিশন মেকার। এখানে সমস্যা হলো জনসংখ্যা ও ট্রাফিক। আমাদের অনেক প্রস্তুতি দরকার। প্রয়োজন সরকারের অংশগ্রহণ। তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি। শহরকে পরিবর্তন করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আগামী দুই বছর পর ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। আমরা ঢাকাকে অনেক স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যাবো। তিনি বলেন, ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। ২৬টি সংস্থা কাজ করে আলাদাভাবে। কিন্তু এর দায় এসে পড়ে সিটি করপোরেশনের ওপর।
তিনি বলেন, এখানে কোনো মাস্টার ড্রেনেজ সিস্টেম নেই। এটা একটা বড় সমস্যা। পাশাপাশি জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকও রাজধানী নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড অনেক দেরিতে শুরু করেছে বলে মনে করেন ঢাকা উত্তরের মেয়র।
মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, এখানে এখনো পরিকল্পিত ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজ, অবকাঠামো নেই। দরকার সেবা খাতের মধ্যে সমন্বয় সাধন। ২৬ সেবা সংস্থা ঢাকায় কাজ করছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনকে সিটি গভর্নমেন্টে পরিণত করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এর ফলে যানজট, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে এখন আমরা পরিকল্পনামাফিক কাজ করছি। আশা রাখি আমরা ঢাকার মূল সমস্যা অচিরেই সমাধান করাতে পারব।
কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, ১৯৮০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। এখন তা বেড়ে এক কোটি ৮০ লাখে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে সাড়ে তিন কোটি। মহানগরীর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ঢাকাকে অবশ্যই সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমন্বয় সাধন এবং বিনিয়োগ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। বিশ্বব্যাংক এই মহানগরীর রূপান্তর ঘটাতে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্য বছরে বিলিয়ন ডলারের অধিক হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/237192