২০ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৩

চিনির মজুদ তলানিতে

দ্রুত ১ লাখ টন আমদানিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন * শুল্ক প্রত্যাহারসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টি চেয়ে শিল্প সচিবের ডিও লেটার
চাল ও লবণের পর এবার তলানিতে নেমেছে সরকারি চিনির মজুদ। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) হাতে মজুদ আছে মাত্র ৩০ হাজার টন, যা দিয়ে ১০ দিনের চাহিদাও পূরণ সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা খোদ সরকারের ভেতরেই বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএসএফআইসির মাধ্যমে দ্রুত এক লাখ টন চিনি আমদানি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বিদেশ থেকে চিনি আমদানির অনুমোদন দিয়েছেন।


এর আগে তলানিতে নেমেছিল চালের মজুদ। আপৎকালীন মজুদ ১০ লাখ টন থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রায় ২ লাখ টনে নেমে আসে। একইভাবে লবণের ঘাটতি সৃষ্টি হয় ২ লাখ ১২ হাজার টন। দেশে ১৫ লাখ টন লবণের চাহিদা থাকলেও উৎপাদন হয় ১২ লাখ ৮৮ হাজার টন। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমদানিনীতি সংশোধন করে ৪ মাসের মধ্যে ৫ লাখ টন লবণ আমদানি উম্মুক্ত করে দিয়েছে সরকার। আর চালের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদেশ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টন আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে আনা ৫০ হাজার টন চাল এরই মধ্যে দেশে ঢুকেছে।

এদিকে চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ও শুল্কসহ অনেক খরচ গুনতে হবে বিএসএফআইসিকে। পাশাপাশি এলসি খোলার জন্য আর্থিক সক্ষমতাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। এসব পরিস্থিতি তুলে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ওই প্রস্তাবে চিনি আমদানিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টি ও স্পেসিফিক ডিউটি প্রত্যাহারসহ তিনটি সুবিধা চাওয়া হয়। গত জুনে এ প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে আধা সরকারি (ডিও) পত্র দিয়েছেন শিল্প সচিব (সিনিয়র)। ডিও লেটারে চিনি আমদানির এলসি খোলার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টি, স্পেসিফিক ডিউটি ও শুল্ক প্রত্যাহার এবং ভর্তুকি সুবিধা চাওয়া হয়।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, ‘বর্তমান বিএসএফআইসির কাছে যে চিনি রয়েছে তা দেশের বাজার স্থিতিশীল ও দর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ পরিস্থিতিতে নিরাপদ মজুদ হিসেবে এক লাখ টন চিনি আমদানির কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী বিএসএফআইসির মাধ্যমে এক লাখ টন চিনি আমদানিসহ কয়েকটি সুবিধা দেয়ার বিষয়ে সানুগ্রহ অনুমোদন দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে আপনার সহায়তা কামনা করছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসএফআইসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বুধবার যুগান্তরকে জানান, আমদানির জন্য চিনির আন্তর্জাতিক দরপত্র খোলা হয়েছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টিসহ সুবিধাগুলো পেলে কার্যক্রম আরও এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, বিএসএফআইসির কাছে পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে চিনির বাজার নিয়ে কেউ কারসাজি করতে পারবে না।

সূত্রমতে, ২ জুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক লাখ টন চিনি আমদানির অনুমোদন চেয়ে প্রস্তাব পাঠান শিল্পমন্ত্রী। সেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী টনপ্রতি সাদা চিনির সিএফআর মূল্য হচ্ছে ৫০১ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে এক লাখ টনের (১০ শতাংশ বেশি, ১ লাখ ১০ হাজার টন) মূল্য আসে ৫ কোটি ৫১ লাখ ৪৩ হাজার ডলার (৪৫২ কোটি ১৭ লাখ টাকা)। এর সঙ্গে বিদ্যমান হারে স্পেসিফিক ডিউটি ৪ হাজার টাকা, ট্যাক্স ৮ হাজার ৩৮৭ টাকা ও ভ্যাট যোগ হবে ৮ হাজার ১৪৮ টাকা। এতে প্রতি টনে শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ যোগ হচ্ছে ২০ হাজার ৫৩৪ টাকা।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, হিসাবে দেখা গেছে, এক লাখ টন চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ও ট্যাক্স বাবদই ২২৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ফলে চিনির প্রকৃত মূল্য ও ভ্যাটসহ অন্যান্য ব্যয় মিলে সর্বমোট ৭০৬ কোটি টাকা প্রয়োজন। এ হিসাবে প্রতি টন চিনির আমদানি মূল্য দাঁড়াবে ৬৪ হাজার ১৮৯ টাকা।

অপরদিকে দেখা গেছে, র-সুগার আমদানিতে প্রতি টন চিনির চট্টগ্রাম সিএফআর মূল্য ৩৬৭ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে স্পেসিফিক ডিউটি ২ হাজার টাকা, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২০ শতাংশ শুল্ক কর বাবদ আরও ১৩ হাজার ৯৭৯ টাকা যোগ হবে। এছাড়া টনপ্রতি রিফাইনারি ব্যয়সহ এক টন চিনির মূল্য ৫০ হাজার ২৮৯ টাকা দাঁড়ায়, যা আমদানি করা সাদা চিনির তুলনায় ১৩ হাজার ৯০০ টাকা কম।

মূল্য পর্যালোচনা করে ওই প্রস্তাবে বলা হয়, সাদা চিনি আমদানি করে বেসরকারি মিল মালিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিক্রি সম্ভব নয়। এতে বিপুল অঙ্কের লোকসান হবে। অপরদিকে র-সুগার রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ কম দামে ও শুল্ক সুবিধায় চিনি আমদানি করে অনেক সময় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেস টু কেস ভিত্তিতে স্পেসিফিক ডিউটি ও ভ্যাট প্রত্যাহারের মাধ্যমে এক লাখ টন চিনি আমদানির অনুমোদন দেয়া হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করাসহ সুলভ মূল্যে চিনি জোগান দেয়া সম্ভব।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, এক লাখ টন চিনি আমদানির জন্য অর্থের জোগান দেয়ার সক্ষমতা বর্তমানে বিএসএফআইসির নেই। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের গ্যারান্টি ছাড়া এ খাতে কোনো অর্থায়ন করবে না। তাই সরকারি খাতে চিনি আমদানিতে অর্থায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গ্যারান্টি দেয়া আবশ্যক। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

এছাড়া ভোক্তার স্বার্থে আমদানি করা সাদা চিনির ক্রয়মূল্য অপেক্ষা কম হারে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হলে ঘাটতির মুখে পড়বে বিএসএফআইসি। এক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, দেশের চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে ১৫টি সরকারি চিনিকল এ বছর উৎপাদন করেছে ৬৯ হাজার ২২৫ টন। তবে চাহিদার বাকি অংশ পূরণ করছে বেসরকারি ৫টি চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। সরকারের উৎপাদিত চিনির থেকে সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী, পুলিশ এবং বিজিবির চাহিদা অনুযায়ী ১০ হাজার ৫৮২ টন সংরক্ষণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৫৮ হাজার ৬৪৩ টন চিনি থেকে রমজানে সুলভ মূল্যে বেচাবিক্রির পর এখন বিএসএফআইয়ের কাছে মাত্র ৩০ হাজার টন রয়েছে, যা দিয়ে স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণসহ ভোক্তার চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/07/20/141151/