২০ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৭

ঢাকায় ভ্রমণে সতর্ক মানুষ

চিকুনগুনিয়ার ভয়ে ঢাকায় ভ্রমণে সতর্ক মানুষ। আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও বেড়াতে আসতে ভয় পাচ্ছেন কেউ কেউ। গ্রামের অনেক মানুষ ঢাকায় স্বজনের বাসায় বেড়াতে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। এমনকি বিদেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা ছুটি কাটাতে ঢাকায় আসার আগে চিন্তাভাবনা করছেন। কেউ কেউ বর্ষা মওসুম পার হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। ঢাকার বাইরে 

দেশের অন্য অঞ্চলে চিকুনগুনিয়ার যেসব রোগী চিহ্নিত হয়েছে তাদের অনেকের ঢাকা ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে। এ কারণে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা লোকজন চিকুনগুনিয়া নিয়ে ভাবছেন।
প্রবাসী কর্মী শাহিনা আক্তার। থাকেন সৌদি আরবের রিয়াদে। তিনি এক মাস আগে দেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আত্মীয়স্বজনের কাছে চিকুনগুনিয়া প্রকোপের বিষয়টি জেনে ছুটি পরিবর্তন করে আগামী জানুয়ারিতে তিনি দেশে আসার পরিকল্পনা করেছেন। ওয়াহিদ রহমান থাকেন প্যারিসে। দেশে আসতে চেয়েছিলেন এ মাসের গোড়ার দিকে। কিন্তু এখন চিন্তা পরিবর্তন করে আগামী বছরের শুরুতে দেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, এবার বর্ষায় ঢাকাতে চিকুনগুনিয়া জ্বরের খবরাখবর তিনি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তাই এ বর্ষায় তিনি আসছেন না- এটা প্রায় নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে থাকেন স্নাতক পড়ুয়া মারজান বেগম। তিনি পরীক্ষা শেষে ঢাকায় মোহাম্মদপুর খালার বাসায় বেড়াতে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চিকুনগুনিয়ার ভয়ে এখন আসছেন না বলে জানিয়েছেন। শুধু শাহিনা, ওয়াহিদ বা মারজান নন, দেশের সর্বত্র এখন চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজধানীতে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের অন্যান্য জেলায়ও চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আক্রান্তদের অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুতেই রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া দেখা দেয়। গত তিন-চার মাসে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। শুরুতে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার ঠেকাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এর প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় রাজধানীতে এর ব্যাপকতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বর্তমানে তা গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। রাজধানীর বাইরে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যেসব রোগীর সন্ধান মিলেছে, তারা ঢাকার মশা দ্বারা আক্রান্ত বলে দাবি করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চিকুনগুনিয়া পর্যবেক্ষণে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করেছে গত ৩রা জুলাই। আইইডিসিআরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯ই এপ্রিল থেকে ১৯শে জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ল্যাবরেটরিতে নিশ্চিত চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা ৭৫০ জন। আগের দিন পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ৭৩৭ জন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠিয়েছিল ৯৫২ জন। সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি। দিন দিনই বাড়ছে চিকুনগুনিয়ার সংখ্যা। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা লাখের বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির কাছে দেশের বিভিন্ন সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা পাঠানো হয়। যদি কোনো ব্যক্তি জ্বর এবং গিরায় ব্যথা বা প্রদাহ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন তবে তিনি সম্ভাব্য রোগী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। এরপর আইইডিসিআর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে যাচাই-বাছাই করে রোগীর সংখ্যা চূড়ান্ত করা হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে ১৭ই জুলাই পর্যন্ত ৭৫ জনে নাম আসে। এর মধ্যে ২১ জন চিকুনগুনিয়া রোগী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে আক্রান্তদের মধ্যে দিনাজপুরে একজন, বগুড়ায় ৮ জন (৪ জনের চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত), জয়পুরহাটে একজন, গোপালগঞ্জে ৯ জন (৫ জনের নিশ্চিত), ঢাকা জেলার (মহানগর ব্যতীত) ১৮ জন ( চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত ৫ জন), নরসিংদীতে ১৪ জন (নিশ্চিত ৯ জন), লক্ষ্মীপুরে ৩ জন ও চট্টগ্রামে ৭জন (সিটি কর্পোরেশন ব্যতীত) বাসিন্দা ছিলেন নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে। এর আগে গত জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় প্রতি ১১ জনের মধ্যে একজন লোক চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিচালিত এক জরিপ থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিষয়টি প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক নিশ্চিত করলে পরে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ওই পরিসংখ্যান সঠিক নয় বলে জানানো হয়েছে। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকুনগুনিয়া হেলপ ডেস্ক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন ১০০ জন করে রোগী বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিচ্ছেন। ভর্তি হচ্ছেন ২ থেকে ৩ জন। গত এক সপ্তাহে ৭০০ থেকে ৮০০ চিকুনগুনিয়া রোগী সেবা নিয়েছেন বলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. শায়েখ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন। ঢামেকের কমপক্ষে ২১ জন নার্স ও ব্রাদার্স চিকুনগুনিয়া জ্বরে ভুগেছেন বলে জানা গেছে।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস টোগা ভাইরাস গোত্রের। এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এ ধরনের মশা সাধারণত দিনের বেলায় (ভোরবেলা অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়। মশাগুলো সাধারণত পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে জন্মে। এ ধরনের পরিবেশে বসবাসকারী মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ হচ্ছে হঠাৎ জ্বর আসা, সঙ্গে গিঁটে গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথাব্যথা, মাংসপেশীতে ব্যথা, বমি বমি ভাব অথবা বমি, চামড়ায় লালচে দানা ওঠা। চিকুনগুনিয়া এমনি এমনি সেরে গেলেও কখনো কখনো গিঁটের ব্যথা কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছরও থাকতে পারে। এই জ্বর ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত হতে পারে। এ রোগ প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, চিকুনগুনিয়া জ্বর যে পরিবেশে ছড়ায়, তার জন্য ঢাকা উপযুক্ত। বৃষ্টি হলে ঢাকার পানি সহজে সরে না। মশার প্রজননক্ষেত্রের জন্য পানি খুবই জরুরি। কিন্তু জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বৃষ্টি হলে সেখানকার পানি আটকে থাকে না। সরে যায়। এ কারণে চিকুনগুনিয়া যে মশার দ্বারা ছড়ায় সেই মশা বংশবিস্তার করতে পারে না। ফলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই।
এদিকে, চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের সব সরকারি হাসপাতালে হেল্পডেস্ক খোলার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির ব্যথা প্রশমনে প্রতিটি হাসপাতালে প্রয়োজনে জয়েন্টপেইন ক্লিনিক বা আর্থালজিয়া ক্লিনিক খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যেখান থেকে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি বা ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হবে। দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও এই সেবা দেয়া হবে। এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সব সরকারি হাসপাতালের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের কাছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ নির্দেশনা পৌঁছে দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ করে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটে। কিন্তু এবার ডেঙ্গু জ্বরের তেমন বিস্তার না ঘটলেও চিকুনগুনিয়া ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে এডিস মশা নিধন জরুরি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এডিস মশা ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার বাহক। ডেঙ্গুজ্বরের সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার অনেক পার্থক্য রয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তদের সাধারণত দীর্ঘ সময় শরীর ব্যথা বা অন্য কোনো সমস্যা থাকে না। জ্বর ভালো হয়ে গেলে কয়েকদিন দুর্বলতা বা ক্লান্তি থাকতে পারে। কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের জ্বর সেরে গেলেও ব্যথা থাকতে পারে দীর্ঘ সময়। আক্রান্তদের অনেকেই দীর্ঘদিনের জন্য স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন। তিনি বলেন, অন্য ভাইরাস জ্বরের মতো চিকুনগুনিয়ার নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। কেউ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগীকে বিশ্রামে থাকার পাশাপাশি প্রচুর পানিসহ অন্য তরল খেতে হবে। জ্বর হলে প্যারাসিটামল খেতে হবে। পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। এদিকে, গত ১৮ই জুলাই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত সেমিনারে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ চিকুনগুনিয়া জ্বরের জন্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, জ্বর হলে খাওয়াতে হবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ। কিন্তু অন্য ওষুধ খেতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকুনগুনিয়ার ৮০ থেকে ৯০ ভাগ রোগী দু’সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যান। ১০ ভাগ রোগী ব্যথায় ভোগেন। যাদের (৬০ বছরের উপরে বয়স) ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা আছে এবং গর্ভবতী মায়েদের ও এক বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে একটু ঝুঁকি থেকে যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে চিকুনগুনিয়া জ্বরকে প্রাদুর্ভাব বলতে পারেন, মহামারী নয়। এই জ্বরকে ল্যাংড়া জ্বরও বলতে পারেন। ওই অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান রিউমাটোলজিস্ট বিএসএমএমইউ’র রিউমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরে খুব কম মৃত্যু হয়। হাজারে একজন। মারা যায় না, বলা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এই জ্বরের জন্য পাইকারি হারে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। চিকিৎসকদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, স্ট্রোয়েডস, আইভি ফ্লুয়েড দেব না।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=74888&cat=2/-