২০ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৩১

পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমের নৈতিকতা

ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক

গণমাধ্যম (মাস মিডিয়া) হলো এমন একটি উপাদান ও প্রযুক্তি, যার সাহায্যে গণমানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। এর সাধারণ প্লাটফরমগুলো হলোÑপত্রপত্রিকা, সাময়িকী, রেডিও-টেলিভিশন, ল্যান্ড ফোন, মোবাইল ফোন, আইপড, বিজ্ঞাপন, সিডি প্লেয়ার, টেপ রেকর্ডার, ক্যাসেট প্লেয়ার, ইন্টারনেট, ফিল্ম, থিয়েটার, ধারণকৃত সঙ্গীত, গ্রন্থ ইত্যাদি। এগুলো আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির উৎপন্ন পণ্যবিশেষ। গণমাধ্যম কথাটি ১৯২৫ সালের দিকে ব্যবহার শুরু হয়। তবে তা কোনো-না-কোনোভাবে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে রয়েছে। প্রথম বই নাকি চীনে ৮৬৩ সালে ছাপা হয়েছিল। সতেরো শতকে ইংল্যান্ডে পত্রপত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়।
গণমাধ্যমের শক্তি দিন দিন বেড়েছে। এখন এটা রাজনীতিবিদ এবং সামরিক প্রোপাগান্ডিস্টদের হাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা এখন ছুরির মতোÑ সার্জনের হাতে সদ্ব্যবহার, আর দুষ্টের হাতে খুনির হাতিয়ারের মতো। বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য তথা ইহুদি গোষ্ঠী এ গণমাধ্যম হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছে। যারা নীতি-নৈতিকতাই মানছে না। যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে মুসলমান তথা আরব-ইরানিদের বিরুদ্ধে। আমরা কিছু সাধারণ তথ্যের সাথে মুসলিমবিরোধী প্রচারণার উল্লেখ করব প্রখ্যাত ব্যক্তিদের মূল্যায়ন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে।
নোয়াম চমস্কির মূল্যায়ন
নোয়াম চমস্কি মার্কিন শিক্ষাবিদ, ইহুদি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সত্য কথা বলেন। তার একটা বক্তৃতার শিরোনাম ‘জার্নালিস্ট ফ্রম মার্স : হাউ দ্য ওয়ার অন টেরর শুড বি রিপোর্টেড’। এটা সংবাদ প্রতিবেদন যথার্থতা ও সঠিকতার পঞ্চদশ বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণ, যা দেয়া হয় ২২ জানুয়ারি ২০০২ সালে। এটি ‘এক্সট্রা’Ñ দ্য ম্যাগাজিন অব ফেয়ারলেস অ্যান্ড অ্যাকিউরেসি ইন রিপোর্টিংয়ের (FAIR) একটি সংখ্যায় প্রকাশিত।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি মোড়ল রাষ্ট্রের ইতিহাস-দর্শন উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস ‘গায়েব’ও করা হয়Ñ তথ্য বেমালুম গুম করা হয় নিজস্ব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঢাকতে। নোয়াম চমস্কি বলেন, ‘লেবাননে ইসরাইলি নৃশংসতার ন্যায্যতার পক্ষেই বলেছিলেন বিখ্যাত ইসরাইলি রাষ্ট্রনেতা আবা ইভান, যা তিনি যথেষ্ট ভয়াবহ বলে স্বীকার করলেও ‘যুক্তিসঙ্গত’ বলে রায় দিয়েছিলেন। সেখানে এমন একটা যৌক্তিক সম্ভাবনা ছিল যে, ভুক্তভোগী লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা বন্ধের জন্য এরপর চাপ সৃষ্টি করবে।’ লক্ষ করুন, সরকারি অর্থে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের এটা আদর্শ নমুনা। যে শত্রুতার কথা তিনি বলছিলেন, তখন তা ইসরাইল-লেবানন সীমানায় ঘটছে। প্রবলভাবেই তার উৎস ছিল ইসরাইলি, আর প্রায়ই অজুহাতহীন সে সব ঘটনায় মদদ জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে প্রথানুযায়ী তা সন্ত্রাসবাদ নয়, এমনকি সে ইতিহাসের অংশও নয়। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট মদদে ইসরাইল লেবাননে আক্রমণ চালায়, সেখানে বোমা ফেলে আর নানা নৃশংসতা ঘটায়। এটি পরিকল্পিত আগ্রাসনের পক্ষে কিছু অজুহাত তৈরির চেষ্টা ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সে অজুহাত অবশ্য তারা খাড়া করতে পারেনি, তবু আক্রমণ করতেও ছাড়েনি। আট হাজার লোককে খুন করা হয়েছিল। দক্ষিণ লেবানন দখল করে প্রায় কুড়ি বছর ধরে তারা সেখানে নানান নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু এর কোনো নথিপত্র নেই, কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষে।
পাশ্চাত্য ও ইসরাইল তথ্য গায়েব করেছে, ইতিহাস চুরি করেছে। অথচ মুসলমানদের হাতে দু-চারজন নিহত হলে ওরা হই হই করে ওঠে সমগ্র মিডিয়া শক্তি নিয়ে। প্রাচ্য দেশীয়দের বিশেষ করে মুসলমানদের রক্ত যেনো রক্ত নয় পাশ্চাত্য ও তাদের গণমাধ্যমের চোখে। যুদ্ধে আর্মেনিয়ার খ্রিষ্টান হত্যার ঘটনার ইতিহাস দুঃখজনক। তা তারা ভুলতে দেয় না, অথচ আরব তথা মুসলিমদের ওপর গণহত্যার তথ্য, ইতিহাস পর্যন্ত গায়েব করছে।
নোয়াম চমস্কি পাশ্চাত্য মিডিয়ার অনৈতিকতা প্রসঙ্গে বক্তৃতায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিনটনের ইসরাইলপ্রীতি নিয়ে লিখেছেন, ২০০০ সালে ফিলিস্তিনি ইনতিফাদার সময়ে; ইনতিফাদা শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ইসরাইলি হেলিকপ্টার নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের মিসাইল দিয়ে আক্রমণ করতে শুরু করে। বহু লোককে হতাহত করে। আত্মরক্ষার কোনো অজুহাতই সেখানে ছিল না তাদের। তবুও কিনটন এই নৃশংসতায় দ্রুত সাড়া দেন। ৩ অক্টোবর ২০০০ সালে, অর্থাৎ মাত্র দু’দিন বাদে ইসরাইলে তিনি একসাথে যত মিলিটারি বোঝাই হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করেনÑ এ দশকে তার চেয়ে বেশি আর কখনো পাঠানো হয়নি। সেই সাথে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের যন্ত্রাংশও দেয়া হয়। এসব তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যম এ কাজে মদদ দিয়েছিল। তারা এর পুরোটাই জানত। চমস্কি উপসংহারে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘গণমাধ্যম যথারীতি তাতে তার স্বকীয় অবদান রাখে।’
এই হলো পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমের নৈতিকতা এবং প্রেস ফ্রিডমের নজির। কখনো চাপে, কখনো ভয়ে, কখনো খুশিমনে তারা মুসলিম প্রসঙ্গের তথ্য লুকায় কিংবা বিকৃতভাবে পরিবেশন করে।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও গবেষক

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/237177