১৯ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১০:৪০

চট্টগ্রাম বন্দরে তীব্র জট : মন্ত্রণালয়ে জরুরি সভা

ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে কর্তৃপক্ষ

চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনারজট, পণ্য খালাসে সময়ক্ষেপণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়ী নেতারা বিদ্যমান সমস্যার জন্য মূলত বন্দর কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন। নৌমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা বললেন, ক্ষমতাবান কারও কথা শুনতে চাই না। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থের পরিপন্থী কাউকে দেখতেও চাই না। তিন-চার মাস নয় দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান চাই। একই সঙ্গে বন্দরে কর্মরত কাস্টমসসহ সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। অন্যথায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সমস্যার কথা তুলে ধরার ইঙ্গিত দেন তারা।


চট্টগ্রাম বন্দরে লাগাতার জাহাজ ও কনটেইনার জটের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার দুপুরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। সভার সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান প্রায় পুরো সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দু-এক দিনের মধ্যে বন্দর সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসার আশ্বাস দেন নৌপরিবহনমন্ত্রী। প্রসঙ্গত চট্টগ্রাম বন্দর উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ওই পরিষদে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনারজট চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে ব্যবসায়ীদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে বলে তারা দাবি করেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা নৌমন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে বন্দরে জটের কারণে মোটা অংকের টাকা গচ্চা দেয়া, রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব, ক্রেতাদের বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে মুখ ফিরিয়ে নেয়াসহ নানা সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। তারা বলেন, বন্দরে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও জাহাজ বার্থিং করতে পারছেন না। দুটি গ্যাংট্রি ক্রেন নষ্ট থাকায় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। বন্দর কাস্টমস, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দেয়ার কথা থাকলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। বন্দর খোলা থাকলে রাজস্ব বিভাগ খোলা থাকে না, রাজস্ব বিভাগ খোলা থাকলে ব্যাংক বন্ধ থাকে। কোথাও সমন্বয় নেই। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালিদ ইকবাল বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনার জটের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি এসব সমস্যা সমাধানে ৩-৪ মাস সময় চান। তবে ব্যবসায়ীরা তাকে ২-৩ সপ্তাহের বেশি সময় দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

তবে ব্যবসায়ী নেতা এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যের প্রায় পুরো সময় নীরব ছিলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও সচিব অশোক মাধব রায়। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে নৌমন্ত্রী বন্দরে জট কমাতে না পারলেও দেশের ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, সময়মতো রফতানি করতে না পারলে শুধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা নয়, দেশের সুনামও নষ্ট হবে। আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ হারাব। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে দু-এক দিনের মধ্যে সবাইকে নিয়ে সমন্বয় সভা করব। ওই সভায় সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং এর সমাধানের চেষ্টা চালানো হবে। এর আগে নৌ সচিব অশোক মাধব রায় বলেন, ভাড়া করে হলেও কম সময়ের মধ্যে ক্রেন আনার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, বন্দরের সঙ্গে রাজস্ব বিভাগ জড়িত। বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কাল (আজ) বৈঠক করবেন নৌমন্ত্রী। বন্দরের সমস্যা সমাধানের সব চেষ্টা করবেন। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ইকুইপমেন্ট আমদানিতে ৩-৪ মাস সময় লাগলে বন্দরে জট কমবে না, ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারব না। সময় কারও জন্য বসে থাকে না। ক্রেন আনতে চার মাস সময় লাগার কথা শুনতে চাই না। বন্দরের এনসিটি অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক বা অন্য কোনো ক্ষমতাবানের কথা বা অন্যকিছু শুনতে চাই না। আমরা চাই, ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে সমাধান। আপনি ওই সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিন। দেশের স্বার্থ, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থের পরিপন্থী কাউকে দেখতে রাজি নই। প্রধানমন্ত্রীর দরজা সবার জন্য খোলা। প্রয়োজনে সেখানে যাব।’ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘বন্দরের টাকা কেন ব্যাংকে অলস অবস্থায় এফডিআর করে রাখা হবে? কোন কমিটি বা কে ওই টাকা বন্দরের উন্নয়ন কাজে ব্যবহারে বাধা দিচ্ছে? আমরা চট্টগ্রাম বন্দরকে সক্ষম দেখতে চাই। এ বন্দরে পণ্য আমদানি-রফতানিতে বেশি সময় লাগায় ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন।’

বন্দরে জট প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালিদ ইকবাল বিদ্যমান সমস্যার কারণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সিসিটির দুটি গ্যাংট্রি ক্রেন ডেমেজ হয়েছে। ঈদের আগে পণ্য আমদানির পরিমাণ বেশি ছিল। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণ ছিল। তিনি বলেন, কনটেইনারজট শুরু হয়েছে গত মাসে। ওই সময়ে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকার কলম্বো থেকে যে সংখ্যক জাহাজ চট্টগ্রামে এসেছে তা রিসিভ করতে পারিনি। তিনি বলেন, বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে দ্রুত দুটি বড় আকারের মোবাইল হারবার ক্রেন আনার চিন্তা করছি। এটি আনতে ৩-৪ মাস সময় লাগবে। এ সময় ব্যবসায়ীরা ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, ক্রেন আনতে ৩-৪ সময় লাগলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা দ্রুত সমাধান চাই।

বন্দর নিয়ে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ৭০টি জাহাজ বহির্নোঙরে রয়েছে। এর মধ্যে কিছু জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করবে। বাকিগুলো সেখানেই পণ্য খালাস করে চলে যাবে। আমি অনুরোধ জানাই, আপনারা গিয়ারলেস জাহাজ কম আনেন, গিয়ার জাহাজে পণ্য আমদানি করেন। এতে জট কমে আসবে। বন্দরের ইকুইপমেন্ট আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে তিনটি রাবার টায়ার গ্যাংট্রি ক্রেন আমদানি করেছি। আরও ৮টি আসবে। হঠাৎ করে একদিনে এসব ইকুইপমেন্ট আমদানি সম্ভব নয়। আগামী বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ ইকুইপমেন্ট আনতে পারব। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, বন্দরে জট কমানোর ক্ষেত্রে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারকসহ অনেকেই জড়িত। আমরা সবার সঙ্গে সমন্বয় করে জট কমানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আগের চেয়ে আমদানি-রফতানি বেড়ে যাওয়ায় জট বেড়েছে। জেটি বেশি থাকলে এ সমস্যা থাকত না। তিনি আরও বলেন, আমাদের আমদানি বেশি হচ্ছে। কিন্তু রফতানি কম। এ কারণে ৫০ শতাংশের বেশি কনটেইনার খালি পাঠাতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান এক ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, এসব বলবেন না। এর সঙ্গে দেশের উচ্চপর্যায়ের পলিসি জড়িত। আমরা খালি কনটেইনার পাঠাতে চাই না, কনটেইনারে পণ্য ভরে পাঠাতে চাই। কিন্তু দেশে উৎপাদন না বাড়লে রফতানি বাড়বে না। অবকাঠামো, গ্যাস সংকটসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সবাই জানে। এসব বলে লাভ নেই। বন্দরের সমস্যার সমাধান চাই।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে পণ্য আমদানি ও রফতানিতে সমস্যা রয়েছে। বিমানবন্দরে মালামাল রাখার শেড নেই, নেই দক্ষ জনবল। বৃষ্টিতে ভিজে মালামাল নষ্ট হয়। মালামাল চুরির ঘটনাও ঘটছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, বন্দরের জাহাজ বার্থিং পেতে ১০-১২ দিন লেগে যায়। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করা হলে স্ক্যানিংয়ে লেগে যায় আরও কয়েকদিন। কোনো কোনো সময়ে পণ্য খালাসে ২-৩ সপ্তাহ চলে যায়। বন্দরে এভাবে সময়ক্ষেপণের জন্য ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে প্রতি কনটেইনারে অতিরিক্ত সারচার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অপরদিকে সঠিক সময়ে পণ্য রফতানি করতে না পারায় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এসব সমস্যার কারণে পোশাক শিল্পের ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে সরে ভারত, কম্বোডিয়া, মিয়ানমারসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, টেক্সটাইল খাতে আমরা লক্ষ্যমাত্রার ১১ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছি। অপরদিকে ভারত ১৪ শতাংশ বেশি রফতানি করেছে। এসব সমস্যা শুধু পোর্টের একার নয়, কাস্টমস, ব্যাংক ও স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

আমদানি-রফতানিতে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যবসায়ীদের এ নেতা নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, রাজস্ব বিভাগসহ সবার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বিদ্যমান সমস্যার দ্রুত সমাধান কীভাবে করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেন।

বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মঈন উদ্দিন আহমেদ মিন্টু চট্টগ্রাম বন্দরের নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরে বলেন, বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনারজট বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, গত এপ্রিল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পোশাক শিল্পের আমদানিকৃত মালামাল খালাসে বিশেষ করে যেসব জাহাজে এলসিএল পণ্যবাহী কনটেইনার বেশি থাকে তা আনস্ট্যাফিং-পূর্বক ডেলিভারি দিতে ১০-১৮ দিন পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। ফলে পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত মালামাল ছাড়করণে দেরির প্রভাব পড়ছে রফতানির ক্ষেত্রে। এতে রফতানি কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে।

বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বন্দরের সংকট তুলে ধরে বলেন, পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট না থাকলে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা শত আন্তরিকতা দেখালেও সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না।

এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ক্রেতাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কত দ্রুত (স্পিড টু মার্কেট) পণ্য পৌঁছানো যায়। এ জায়গাটিতে আমরা মার খাচ্ছি। সম্ভাবনাময় পোশাক ও পাদুকা শিল্প বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যে জাহাজটি ৭ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছল, সেটি ১৭ জুলাই সিসিটিতে বার্থিং পাচ্ছে না। বেনাপোল স্থলবন্দরের অবস্থাও ভালো নয়। সঠিক সময়ে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে দ্রুত তা রফতানি করতে পারব না। বন্দরে জটের জন্য সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্দর খোলা থাকলে রাজস্ব বিভাগ খোলা থাকে না, রাজস্ব বিভাগ খোলা থাকলে ব্যাংক খোলা থাকে না। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সব বিভাগের সহযোগিতা দরকার। ওই সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য মো. জাফর আলম, বিটিএমএ’র সভাপতি তপন চৌধুরী, বিজিএমইএ’র পরিচালক মো. মনির হোসেন, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু নাসের প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/19/140900/