১৯ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১০:২৩

দুর্যোগের ঘনঘটা বাড়ছে

আবহাওয়া-প্রকৃতির বৈরী আচরণ চলতে পারে নভেম্বর পর্যন্ত : বন্যা পাহাড়ধসের ঝুঁকি কাটেনি

দেশে দুর্যোগ-দুর্বিপাকের ঘনঘটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে নানামুখী জনদুর্ভোগ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শহর ও গ্রামের প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং জনস্বাস্থ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ধারায় ভাটির দেশ এবং বঙ্গোপসাগরের ফানেল (চোঙা) আকৃতির ব-দ্বীপ বাংলাদেশে এসে পড়ছে অনেক ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ও ধকল। চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। প্রকৃতির বৈরী আচরণ অর্থাৎ চলমান দুর্যোগের ঘনঘটা আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাস (কার্তিকের তুফান মওসুম) পর্যন্ত অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো একথা জানায়। এদিকে চলতি বছরে দুর্যোগের মাত্রা ও ব্যাপকতা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশিই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিগত মার্চ মাস থেকে আবহাওয়া-প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে। তখন থেকে শুরু করে চলতি জুলাই মাসের এ যাবত একে একে খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল-বান, বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে অতিবর্ষণে পাহাড়ি ঢলজনিত বন্যা ও পাহাড়-টিলা ধসে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি, উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী খরা অনাবৃষ্টির পর উত্তর জনপদ থেকে বৃহত্তর সিলেট, মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত চলমান বন্যাজনিত উপর্যুপরি দুর্যোগ অব্যাহত রয়েছে। 

গতকাল (মঙ্গলবার) উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে বিরাজমান নিম্নচাপের সক্রিয় প্রভাবে দেশের অনেকগুলো জেলায় অসময়েই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তিন দিন ধরে। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। ঘোর বর্ষার মাস শ্রাবণের শুরুর দিনগুলো বৃষ্টিবিহীন। নিম্নচাপটি কেটে গেলে ফের মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে এক বা দু’টি করে বৃষ্টিবাহী মৌসুমি নি¤œচাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জানায় আবহাওয়া বিভাগ। এবার আগাম মৌসুমি বায়ুতাড়িত বন্যা হয়েছে। তবে শ্রাবণ ভাদ্র মাস পর্যন্ত (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে অতীতে ব্যাপক বন্যার রেকর্ড রয়েছে। তাছাড়া ভারতের আবহাওয়া বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়, এবছর দেশটিতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিহারেই ভারীবর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। তখন উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানভাগে বর্ষণের ঢল দেশের নদ-নদীগুলোকে ফের প্লাবিত করে তুলতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে দেশ এখনও বন্যার পুরেপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়। আবার অতিবৃষ্টি হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সফিউল আলম গতকাল ইনকিলাবকে জানান, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণজনিত সঙ্কট মোকাবিলায় আমাদের সবরকম প্রস্তুতি ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। বেশিহারে নিবিড় বনায়ন করতে হবে। একদিকে হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলের ভাটিতে, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের কোলে ব-দ্বীপভূমিতে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও বাংলাদেশে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরার মতো দুর্যোগের ধকল পড়ছে আরও বেশিমাত্রায়। এলোমেলো ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া-প্রকৃতির রুদ্ধ-রুক্ষ আচরণে দুর্যোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ রিয়াজ আখতার মল্লিক ইনকিলাবকে জানান, এবার মৌসুমি বায়ুর আগমন ও সক্রিয়তা আগেভাগে, বর্ষাও শুরু হয়েছে বেশ আগেই। তাই দেশে আগাম বন্যাও হয়েছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের পরিচায়ক। এবার বর্ষা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে নদ-নদীতে পানিবৃদ্ধি কিংবা বন্যা, দুর্যোগের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে তা নির্ভর করছে উজানে মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা এবং বর্ষণের মাত্রার উপর। সরকারকে সম্ভাব্য যেকোন দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ আসার আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী যদি জুলাই, আগস্ট মাসে ‘এ সময়ের জন্য স্বাভাবিক’ হারে বর্ষণও হয় তাহলেও বৃষ্টিপাত হতে পারে প্রচুর। বাংলাদেশে ক্রমাগত বৃষ্টিপাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ বিষয়টি গবেষণা করে দেখিয়েছেন ড. মল্লিক।
এদিকে এলোমেলো আবহাওয়ার বিরূপতার শুরু গত মার্চে। বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতি, খরা ও অনাবৃষ্টির মধ্যেই গত এপ্রিলে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা আকস্মিক ঢলে ভয়াবহ দুর্যোগ চেপে বসে বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে। মে মাসে সমগ্র দেশে অস্বাভাবিক ও দীর্ঘতর তাপপ্রবাহ, উপকূলভাগে গুমোট আবহাওয়া পুঞ্জিভূত দুর্যোগের আলামত বহন করে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র (৩০ মে) আঘাতের পর দুর্যোগের ঘনঘটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আবহাওয়ার ‘এল-নিনো’ অবস্থা (বৃষ্টি রোধকারী) নীরবে কমতে শুরু করলে বাংলাদেশ, ভারত, চীনে বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ুমালা আগাম জোরালো হয়ে উঠে। বাংলাদেশে ও উজানের অতিবৃষ্টিতে ঢল-বন্যার কারণ ঘটে। ১২-১৩ জুন একটি মৌসুমি নি¤œচাপের জোরালো প্রভাবে অতিবৃষ্টিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধসের বিপর্যয় এবং আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এরপরই উজানের প্রবল ঢলে এ মাসের গোড়া থেকে প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে এবং উত্তর জনপদ, বৃহত্তর সিলেট ও মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বন্যা কবলিত হয়।
সামগ্রিকভাবে আবহাওয়া-জলবায়ুর রূপ বদল চরম ভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একের পর এক দুর্যোগে তৈরি হচ্ছে জনদুর্ভোগ ও সঙ্কট। চিরায়ত ষড়ঋতুর আদি চরিত্র বদলে যাচ্ছে। পঞ্জিকা মাফিক বর্ষায় বৃষ্টি ঝরে কম, প্রাক-বর্ষা ও পরবর্তী সময়ে ঝরে আরো বেশি। শীত মানুষকে কাঁপায় না। গ্রীষ্মের খরতাপ মরুর আগুনের হলকা হয়ে আসে। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত আলাদা করে জনজীবনে অনুভূতি জাগায় না। আবহাওয়া-প্রকৃতির বিরূপতা সব শ্রেণী-পেশা-বয়সের মানুষের জীবনযাত্রায় নানামুখী অনিষ্ট ও ভোগান্তি বয়ে আনছে। ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে মানবসম্পদের গড় উৎপাদনশীলতা। কমছে সক্ষমতা। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি ও করাল গ্রাসে বসতি হারিয়ে পিছু হটে মূল ভূখন্ডের দিকে ধাবিত হচ্ছে উপকূল চর দ্বীপাঞ্চলের অভাবী মানুষেরা।
জনবসতি, কৃষি-খামার, জীবিকা, জনস্বাস্থ্য, উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ জনজীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে গিয়ে পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। আকস্মিক ও অকাল বন্যা, পাহাড়ি ঢল, খরতাপ ও শুষ্কতা, খরা, হঠাৎ ভারীবর্ষণ, পানিতে আর্সেনিক ও লবণাক্ততার আগ্রাসন বৃদ্ধি, অতিআর্দ্র ও উষ্ণতা বাড়ছে। মৌসুমি ভাইরাসজনিত (ট্রপিক্যাল) বিভিন্ন জানা-অজানা রোগ-ব্যাধি যেমন- সর্দিকাশি, হাম, টিবি, প্রদাহজনিত জ্বর, বাতজ্বর, ফ্লু, পেটের পীড়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির দিকে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা হারাচ্ছে মানুষ। স্বাস্থ্যরক্ষায় এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও নির্ভরতা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া গাছপালা, জীববৈচিত্র্য, প্রাণিকুল হারিয়ে ফেলছে তাদের বাঁচার অবলম্বন খাদ্য-শৃঙ্খল (ফুডচেইন)। প্রাকৃতিক উৎসের ও কৃষিজ খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পুষ্টিমানও অনেকাংশে লোপ পেয়েছে। বেড়ে গেছে সার ও কীটনাশকের অতিমাত্রায় ব্যবহার।

https://www.dailyinqilab.com/article/88127/