১৯ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১০:২২

এমপিদের পছন্দের বাজার উন্নয়নে ১৭৮৫ কোটি টাকা

সিটি করপোরেশনের বাইরের সব আসনের সংসদ সদস্যরা (এমপি) নিজ নিজ এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ করতে পাঁচ বছরের জন্য ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছেন বছর দুয়েক আগে। এমপিদের নিজ আসনের মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ, শ্মশানসহ সর্বজনীন অবকাঠামো উন্নয়ন বাবদ আরো দুই কোটি টাকা করে পাওয়ার প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসবের পর এমপিদের দাবির মুখে এবার বাজার উন্নয়ন বাবদ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সদ্য শুরু হওয়া অর্থবছরের বাজেটের থোক বরাদ্দ থেকে ওই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে এমপিদের আসনভিত্তিক নাকি উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়া হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন। এ নিয়ে আলোচনা চলছে। পরিকল্পনা কমিশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সুশাসন এবং স্থানীয় সরকার বিষয়ের গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় সব সরকারের আমলেই নির্বাচনের আগে এভাবে এমপিদের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওই অর্থ এমপিদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে লাগানো হয়ে থাকে। এবারও জনগণের করের এই টাকা এমপিদের নির্বাচনী প্রচারে খরচ হওয়ার আশঙ্কা করছেন ওই বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের প্রকল্পে অর্থ খরচে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিরও সুযোগ তৈরি হয়।
সামনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। তাই নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে এমপিদের। এমন বাস্তবতায় হাট-বাজার উন্নয়নের নামে আলাদাভাবে টাকা চেয়েছেন এমপিরা। এমপিদের দাবির মুখে বাজার উন্নয়ন করতে ‘দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন’ শিরোনামে এক হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়া করতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাজার উন্নয়নে প্রতিটি উপজেলায় তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হবে। এমপিদের পছন্দমতো প্রতিটি উপজেলা থেকে নির্বাচিত একটি বাজারের উন্নয়ন করা হবে। একটি বাজার উন্নয়নে তিন কোটি টাকা করে
খরচ ধরেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি বাজার হবে চারতলা ফাউন্ডেশনের ওপর দোতলা। বাজারের জন্য যে নকশা তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে, সবজি বিক্রির জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা রাখা হবে। মাছ বিক্রির জন্য আলাদা জায়গা থাকবে। এ ছাড়া মাংস বিক্রির জন্য থাকবে আলাদা স্থান। গাড়ি পার্কিং, চা স্টলের জন্য আলাদা জায়গা করা হবে। যেখানে এখন টিনের বাজার আছে, সেগুলো ভবন করা হবে। এমপিরা যেসব বাজার নির্বাচিত করে দিয়েছেন, এলজিইডি সেসব বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন করবে।
তবে এসব প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। তাদের মতে, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বাজার নির্মাণে যে তিন কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে, তা অনেক বেশি। এ ছাড়া দেশের প্রায় সব স্থানেই এখন হাট-বাজার উন্নয়নের কাজ চলছে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে যাতে দ্বৈততা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে কমিশনের যুক্তি হলো দেশের কোনো কোনো আসনে উপজেলা আছে সাতটি। প্রতিটি উপজেলায় তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ দিলে ওই আসনের এমপি বরাদ্দ পাবেন ২১ কোটি টাকা। আবার কোথাও কোথাও দুই উপজেলা মিলে একটি আসন আছে। তাহলে ওই আসনের এমপি পাবেন তিন কোটি টাকা করে ছয় কোটি। এতে সংসদ সদস্যদের মধ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হবে। এতে করে বরাদ্দ কম পাওয়া এমপিরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাই সবাই যাতে সমানভাবে বরাদ্দ পান, সে জন্য আসনভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছে পরিকল্পনা কমিশন।
‘দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন’ শিরোনামে প্রকল্পটি নেওয়ার পেছনে এলজিইডির যুক্তি হলো কৃষিপ্রধান এ দেশের অর্থনীতি এখনো কৃষির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হলেও দেশের কৃষকরা কখনো তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। মধ্যস্বত্বভোগীরা বছরের পর বছর ধরে মুনাফা করে যাচ্ছে। কৃষক তার পণ্যের সঠিক দাম পায় না। কৃষক যাতে তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সে জন্য বাজার উন্নয়ন করা হবে। কৃষকরা যাতে বাজারে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এতে করে কৃষকদের পরিবহন ব্যয় কমবে। ভোক্তাও সঠিক দামে পণ্য পাবে।
এর আগে মসজিদ-মন্দির উন্নয়নের লক্ষ্যে এমপিদের জন্য আরো একটি প্রকল্প হাতে নেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। ৬৭৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ‘সর্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটিও অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে প্রত্যেক সংসদ সদস্য নিজ এলাকার কবরস্থান, শ্মশান, মসজিদ, মন্দির, চার্চ, গির্জা, প্যাগোডা, ঈদগাহ, খেলার মাঠসহ সর্বজনীন অবকাঠামো উন্নয়ন বাবদ আলাদা করে টাকা পাবেন। পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এ ধরনের উদ্যোগ নিরপেক্ষতা নষ্ট করে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৭ জুলাই একনেক সভায় ছয় হাজার ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন’ শিরোনামের একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের আওতায় একজন এমপির নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়ন বাবাদ প্রতিবছর চার কোটি টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ২০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। ওই প্রকল্পের আওতায় এমপিরা চাহিদামতো এলজিইডির কাছে তাঁদের এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা দেন। এমপিদের দেওয়া তালিকা ধরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। এমপিদের জন্য নতুন করে ‘দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন’ এবং ‘সর্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন’ শিরোনামের আরো দুটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এগুলো শিগগিরই একনেক সভায় অনুমোদন পাওয়ার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের আগে আগে এমপিদের পছন্দমতো মসজিদ, মন্দির ও বাজার উন্নয়নের নামে নেওয়া প্রকল্পগুলো পুরোপুরি রাজনৈতিক ও অপচয়ের প্রকল্প। এগুলো অপচয়ী প্রকল্পের উদ্ভাবন মাত্র। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় যেসব বাজার উন্নয়ন করা হবে, সেগুলো কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়েছে? কত সংখ্যক মানুষ সেসব বাজার ব্যবহার করে? সরকার ওই সব বাজার থেকে বছরে কত টাকা রাজস্ব পায়? এসব বিষয়ের মূল্যায়ন হয়েছে কি?’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশে এমনিতেই বাজারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সারা দেশই এখন বাজারে পরিণত হচ্ছে। তাহলে বাজার উন্নয়নের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? বিশাল বাজেটের প্রকল্পটি নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা হয়েছে কি না, তারও কোনো খবর নেই। ’ তোফায়েল আহমেদ বলেন, এমপিদের পছন্দমতো বাজার উন্নয়ন প্রকল্পটি অযৌক্তিক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দের পক্ষেও না, আবার আসনভিত্তিক বরাদ্দের পক্ষেও না। আমার জানার বিষয় হলো যেসব বাজার নির্বাচিত করা হয়েছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ কি না। নাকি প্রভাব বিস্তার করে প্রকল্পে নাম ঢোকানো হয়েছে। বাজার নির্বাচন করতে চূড়ান্ত জরিপ করা হয়েছে কি না। ’
এসব বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমপিরা তাদের পছন্দমতো বাজারের নাম দিয়েছেন। এলজিইডি সেই পছন্দমতো কাজ করবে। এ ছাড়া কোন বাজার থেকে কত টাকা রাজস্ব আদায় হয়, কিংবা ওই সব বাজার গুরুত্বপূর্ণ কি না, এসব বিষয়ে জরিপ এবং বিস্তারিত সমীক্ষা হয়নি বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের আগে এভাবে টাকা বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ ভুল বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সংগঠক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, এভাবে টাকা বরাদ্দ দিলে জনগণের অর্থের অপচয় হবে। সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারে এই অর্থ খরচ হতে পারে বলেও তাঁর আশঙ্কা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের আগে এভাবে টাকা বরাদ্দ দেওয়া রাজনীতিতে ধারাবাহিক চিত্র বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/07/19/521082