বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ইতোমধ্যে দশটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অপর দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে এ পর্যন্ত ১১ জনকে দেখেছে এ দেশের মানুষ। ১২তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা এখন দায়িত্বে আছেন। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। আগের প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে সাতজন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা সাবেক বিচারক; চারজন ছিলেন সাবেক ঊর্ধ্বতন আমলা। আর তাদের সাথে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন ২৩ জন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস। সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
স্বাধীন রাষ্ট্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, ১৯৭৩ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে তা তিরোহিত হয়। স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনটি ছিল জবরদস্তিমূলক ও কার্যত একদলীয় নির্বাচন। মতায় থেকে সরকার নির্বাচন পরিচালনা করলে নির্বাচনের ফল কেমন হতে পারে তার নগ্ন নজির ছিল সেই নির্বাচন। মতাসীন আওয়ামী লীগ ২৮৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৮২ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। আওয়ামী লীগের মোকাবেলা করার মতো বিরোধী দল না থাকা সত্ত্বেও ভোট কারচুপির ব্যাপক নজির স্থাপন করেছিল মতাসীন দল। আগের বছর ছাত্রলীগ থেকে রব-জলিল ও সিরাজুল আলম খানের গড়া জাসদ ২৩৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র একটি আসন পায়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদেই ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনা নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। সব রাজনৈতিক দল বিলোপ করে একদলীয় ব্যবস্থা বা বাকশাল কায়েম হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও বিলুপ্তি ঘটেছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দশটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি হিসেবে জাঁদরেল বিচারপতি ও আমলারা দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তারা সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে একতরফা নির্বাচনের তীব্র সমালোচনা করে এটি ভোটারবিহীন নির্বাচন বলে উল্লেখ করে থাকেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৪১টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। প্রার্থী ছিলেন এক হাজার ৪৫০ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৯ জন। ভোট পড়েছিল ২৭ শতাংশ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এ কে এম সাদেক। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তখন একযোগে ‘সাদেক মার্কা নির্বাচন চাই না’ বলে রাজপথে প্রচণ্ড আন্দোলন করেছেন। সেই আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে অদ্ভুত এক সংসদ নির্বাচন হয়েছে, যেখানে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫১ আসনেই সংসদ সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি আসনের নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ৫ শতাংশের মতো। ভোটকেন্দ্রে মানুষ তো ছিলই না, অনেক সংবাদপত্র ব্যালট বাক্সের পাশে কুকুর শুয়ে থাকার ছবি ছেপেছে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিলÑ কলঙ্কিত নির্বাচন। বেশি দিন নয়, তিন বছর আগের ঘটনা। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাংবিধানিক পদের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক আমলা কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ। বিরোধী দলের নেতারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বহু আগেই বলছেন, আগামী নির্বাচন যেন ‘রকীব মার্কা’ না হয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনার কোন ধরনের নির্বাচনের আয়োজন করবে, তা এখন বলা যাচ্ছে না। নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে। তবে আলামত ভালো নয়। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে যখন নিয়োগ দেয়া হয়, তখন বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতারা তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যদিও এ নিয়ে এখন তারা অনেকটাই নিশ্চুপ। রাজনীতিতে এখন গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিরোধী দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। এমনকি ঘরোয়া রাজনীতি বাস্তবে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মামলা আর গণগ্রেফতারে কাহিল বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। এই বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে, নির্বাচন কি হবে? হলেও কেমন নির্বাচন হবে? এ দেশের মানুষ অন্তত তিনটি নির্বাচনে অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পেরেছে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১Ñ এ তিনটি নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ২০০৭ সালের নির্বাচনও হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। রাজনীতিকদের ওপর সেই সরকারের নানা নিপীড়নমূলক তৎপরতা এবং নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে জবরদস্তিমূলক বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা বিতর্কিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছে। এখন সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন হবে। সেখানেই যত ভয়। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আর স্বাধীন থাকে না। ১৯৭৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, কোনোটিই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে হতে পারেনি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর প্রথম প্রশ্ন উঠেছে, কোণঠাসা হয়ে পড়া বিরোধী দল এই রোডম্যাপ থেকে কি কোনো আস্থা পাচ্ছে? ক্ষমতাসীন দল রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কোনো আলোচনা ছাড়া ঘোষিত রোডম্যাপে একাদশ সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ চলমান সঙ্কটের সমাধান দেবে না। বিএনপি এখন পর্যন্ত রোড দেখতে পাচ্ছে না, ম্যাপ তো পরের প্রশ্ন। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়। তার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হলে তাতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আর সংসদের বিরোধী দল যারা ক্ষমতায়ও আছেন, সেই জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদের বলেছেন, বর্তমান কমিশন এখন পর্যন্ত ভালো ভূমিকা রেখেছে। তাদের সন্দেহ করার মতো অবস্থা হয়নি। এটাও প্রমাণ হয়নি যে, তারা সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন। এখন দেখতে হবে, শেষ পর্যন্ত কী হয়।
শেষ পর্যন্ত কী হবে তা দেখার জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হবে, তেমনি কমিশনের কর্মপরিকল্পনার মধ্যে অনুমান করা যায়Ñ আগামী দিনগুলো কেমন যাবে। সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির প্রথম শর্ত হলো, সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী কমিশন নির্বাচনী আইনের সংস্কার, আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন গ্রহণের মতো কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিঃসন্দেহে এসব কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বলয়ের বাইরে গিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি না, সেই সংশয় দূর করা।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তাতে এসব বিষয়ে অনেক অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। যেমনÑ নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। অতীতে যেসব নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, সেগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে কি না এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কিছু বলেনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। কিভাবে ক্ষমতাসীন দলের সাজানো প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করবেন, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কিভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা এই রোডম্যাপে নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিষয়টি নাকচ করে দেয়া হলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইভিএমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ইভিএমে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের রোডম্যাপ ঘোষণার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেÑ নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হবে। এসব পরামর্শ নির্বাচন কমিশন কতটা বাস্তবায়ন করতে পারে, তার ওপর কমিশনের স্বাধীন অবস্থানের দিকটি স্পষ্ট হবে। সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, একটি সহায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা হবে। তাতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও নিশ্চয়ই উল্লেখ করা হবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারছে নাÑ এমন অভিযোগ থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল। এই দাবি পূরণের জন্য তৎকালীন বিরোধী দল মোট ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। ২৬ দিন অসহযোগ ও লাগাতার ৯৬ ঘণ্টার হরতাল করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই আন্দোলনে বহু লোক হতাহত হয়েছিল। শুধু রোডম্যাপ ঘোষণা নয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে কি না সে ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা থাকতে হবে। এই রোডম্যাপ নির্বাচন কমিশনের রুটিন কাজের অংশ। রোডম্যাপে আস্থা অর্জন করা যাবে না। দরকার মেরুদণ্ড সোজা করে চলা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারের বাইরে চলতে না পারলে আরেকটি ‘সাদেক-রকীব মার্কা’ নির্বাচন করতে হবে এবং কলঙ্কিত নির্বাচনের তিলক নিয়ে বিদায় নিতে হবে।
alfazanambd@yahoo.com