১২ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:৪০

চিকিৎসা বিশৃঙ্খলায় চিকুনগুনিয়া রোগী

চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে চলছে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। চিকিৎসকরা যে যাঁর মতো করে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা-পরামর্শ ও ওষুধপথ্য দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, শুধু প্যারাসিটামলেই চলবে, কেউ দিচ্ছেন একাধিক ওষুধ। যেখানে-সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে রোগের। এসব নিয়ে চরম বিভ্রান্তিতে পড়েছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।

আবার চিকুনগুনিয়ার ওষুধ নিয়ে কারসাজিও শুরু হয়েছে বাজারে। প্যারাসিটামলের ঘাটতি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম ঘাটতির ঘটনাও ঘটছে। কেউ কেউ বাড়তি দাম নিচ্ছে ক্রেতাদের কাছ থেকে। এসব বিষয়ে কোনো নজরদারি করছে না স্বাস্থ্য বা ওষুধ অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মশা নিধন বা সচেতনতাই নয়, এর সঙ্গে সরকারকে চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনায়ও নজর দেওয়া জরুরি।

খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই এক কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছেলেটা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। কী করব না করব—বুঝে পাচ্ছি না। ’ চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকারি সব প্রচার-প্রচারণায় দেখছি, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধের দরকার নেই। কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলে তো অনেক ওষুধ দেয়। আবার পরিচিত যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের তো দেখলাম ট্যাবলেট, ইনজেকশন, স্যালাইন, ক্যাপসুল কত রকম ওষুধ দিয়েছে। আসলে কী যে হচ্ছে তা তো বুঝতে পারছি না! তাই আমার ছেলেটাকে কোথায় নেব না নেব বুঝতে পারছি না! ’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের স্ত্রী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর চিকিৎসা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। তাঁর প্রেসক্রিপশনে ব্যথার ওষুধ দেখে খেপে যান ওই অধ্যাপক। তিনি ওই ব্যথার ওষুধ বাদ দিয়ে অন্য ওষুধগুলো সেবনের জন্য স্ত্রীকে পরামর্শ দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অধ্যাপক কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠলে মেডিসিনের ডাক্তার নানা ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে ফেলেন। কিন্তু এর অন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবেন না। এটা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার। বড় বড় ডাক্তারদেরও দেখছি এই কাণ্ড করছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল জাতীয় সংসদে বলেছেন, শুধু প্যারাসিটামল আর পানিতেই চিকুনগুনিয়া ভালো হয়ে যায়। এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। গতকাল এক অনুষ্ঠানেও তিনি চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কিত বা কোনো রকম বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, চিকুনগুনিয়া মরণব্যাধি নয়। এটি এখন পর্যন্ত মহামারি রূপ ধারণ করেনি। চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা নিধনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। এরই মধ্যে সচেতনতা, চিকিৎসা আর মশা নিধনে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান খ্যাতিমান কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্যারাসিটামল ছাড়া কোনোভাবে ব্যথা কমাতে স্টেরয়েড তো নয়ই, নন স্টেরয়েডও দেওয়া যাবে না। ডাইক্লোফেনাকের মতো ওষুধগুলো খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু আমরা শুনতে পাচ্ছি, চিকুনগুনিয়ার রোগীদের ব্যথা কমাতে এনএসএইড দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ চিকুনগুনিয়া নিয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো সভায় অংশ নিয়েছেন সবগুলোতেই জোর দিয়ে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে ভয়ের কিছু নেই। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধের দরকার নেই। একই কথা বলেন ওই অধিদপ্তরের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও।

তবে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত আইনজীবী আশরাফ উল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চিকুনগুনিয়ার ওষুধ শুধু প্যারাসিটামল বলে শুনেছি। আবার শুনেছি, চিকুনগুনিয়ার কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমি জ্বর আর ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তিন দিন একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ছিলাম। সেখানে প্রতিদিনই প্যারাসিটামলের বাইরে ইনজেকশন, অন্য ট্যাবলেট ও স্যালাইন দিয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পমাত্রার স্টেরয়েডও ছিল বলে শুনেছি। আর সেখানে দুই দফা চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষাও করা হয়েছে। বেড ও চিকিৎসকের ফি বাদে কেবল ওষুধ আর পরীক্ষার পেছনেই আমার চলে গেছে সাত-আট হাজার টাকা। ’

খাদেমুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমার মেডিসিনের চিকিৎসক মোট পাঁচ ধরনের ওষুধ দেন। এর মধ্যে পেইন কিলারও ছিল। কিন্তু আমার হার্টের চিকিৎসককে ওই প্রেসক্রিপশন দেখালে তিনি মেডিসিনের চিকিৎসকের উদ্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে আমাকে ওই ব্যথার ওষুধ পরিহার করতে বলেন। শুধু প্যারাসিটামলই চালাতে বলেন পরিমিত পরিমাণে। ’

রাজধানীর গ্রিন রোডে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করান মোহাম্মদপুরের আকবর হোসেন। জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, চিকিৎসকের পারমর্শেই তিনি ওই পরীক্ষা করিয়েছেন।

নিপসমের অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসার জন্য গাইডলাইন প্রকাশ হয়েছে। সেটা ফলো করলে বিভ্রান্তির সুযোগ কমে যাবে। তবে অনেক চিকিৎসক হয়তো নিজস্ব কোনো বিশেষত্ব বজায় রাখতে পারেন, একাধিক ওষুধ দিতে পারেন। সেটার দায়িত্ব সেই চিকিৎসকের। এ ছাড়া সাধারণত জোড়ার ব্যথা কমাতে এনএসএইড বা নন-স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ অনেকে দিয়ে থাকেন। আর্থ্রাইটিসের সমস্যার কারণে এটা দেওয়ার প্রচলন আছে। এতে খুব একটা ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তবে স্টেরয়েড পরিহার করা আবশ্যক।

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত চিকুনগুনিয়া প্যারাসিটামলেই সেরে যায়। কিন্তু যাদের ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাদের জন্য আর্থ্র্রাইটিস রোগীদের যে ব্যবস্থাপনা দেওয়া হয় সেটি প্রয়োজ্য। অর্থাৎ এনএসএইড দেওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে আগে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে ওই রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নয় কিংবা লিভার বা কিডনির রোগ নেই।

ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের মেধা ও দক্ষতার ব্যাপার থাকতে পারে। যদি তিনি রোগীর সঠিক সমস্যাগুলো শনাক্ত না করেই ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক দিয়ে দেন তবে তা রোগীর জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘চিকিৎসা নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নেই। আমরা সব হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসাসংক্রান্ত গাইডলাইন পাঠিয়েছি। এ ছাড়া চিকিৎসক-নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবেলায় হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে। এ ছাড়া চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির ব্যথা প্রশমনে প্রতিটি হাসপাতালে প্রয়োজনে জয়েন্ট পেইন ক্লিনিক বা আর্থালজিয়া ক্লিনিক খোলারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখান থেকে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি বা ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হবে। দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও এই সেবা দেওয়া হবে। এর আগেই চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষণের জন্য পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার (চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) খোলা হয়েছে।

এদিকে চিকুনগুনিয়া মানেই প্যারাসিটামল ওষুধ—এমন প্রচার পাওয়ার পর বিভিন্ন এলাকার ওষুধের দোকানগুলোতে বিশেষ বিশেষ কোনো কম্পানির প্যারাসিটামলে ঘন ঘন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও দামেও হেরফের হয়ে যাচ্ছে অল্প সময়ের ব্যবধানে।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, গতকাল সকালে স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে নাপা এক্সটেন্ড ব্র্যান্ডের প্যারাসিটামল কিনতে গিয়ে ফিরে এসেছি। পরে ধানমণ্ডির আরেক ফার্মেসিতে গিয়ে বেশি দাম দিয়ে এক পাতা ওই প্যারাসিটামল কিনতে হয়েছে। দাম বেশি রাখার কারণ সম্পর্কে ওই ফার্মেসি থেকে বলা হয়েছে, ‘এই আইটেমটির চাহিদা বেশি, আমরাও চাহিদামতো পাই না, তাই দাম বেশি পড়ে গেছে। ’

জানতে চাইলে লাজফার্মার মিরপুর পল্লবী শাখার বিক্রয়কর্মী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুরুর পর থেকেই গত কয়েক দিন ধরেই নাপা এক্সটেন্ড, নাপা এক্সট্রা আর সাধারণ নাপা—সবগুলোরই চাহিদা বেড়ে গেছে। এর মধ্যে নাপা এক্সটেন্ডের চাহিদা বেশি হওয়ায় মাঝেমধ্যেই ঘাটতি দেখা দেয়। এক দিন পাই তো আরেক দিন পাই না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশে আর কোথাও চিকুনগুনিয়ার কার্যকর কোনো পরীক্ষার প্রযুক্তি নেই। কেউ অন্য কোথাও চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করিয়ে থাকলে সেটা নিশ্চিত কোনো পরীক্ষা বলা যাবে না। ওই ফলাফল পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না। এর ভিত্তিতে চিকিৎসা নেওয়াও ঠিক নয়। কারণ সঠিক রিপোর্ট না হলে চিকিৎসাও সঠিক না হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/12/518186