১২ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৩৪

তালিকায় চুনোপুঁটি অধরা রাঘববোয়াল

দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ, সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ, সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য বর্জনের পরামর্শ

জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপি চুনোপুঁটিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে অধরাই থেকে গেছে রাঘববোয়ালরা। আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন থেকে চিহ্নিত এসব বড় বড় জালিয়াত এক্ষেত্রে ঋণ পুনর্গঠনসহ নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। এদের সুরক্ষা দিচ্ছে সরকারের একটি অংশ।

এদিকে খেলাপি ঋণ আদায় এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং বিশিষ্টজনরা। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ, সরকারের পক্ষ থেকে এদের সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং এদের সামাজিকভাবে বয়কট করা। ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বর্জন করে তাদের আর্থিক খাতে বিকলাঙ্গ করার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। ‘মাদককে না বলুন’- এমন স্লোগানের মতো ঋণখেলাপিদেরও বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘ঋণখেলাপিদের না বলুন’ এই স্লোগান সমাজে সব স্তরে ছড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বিচারহীনতার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দুর্নীতিবাজ এবং ধড়িবাজরাই ক্ষমতার জোরে ব্যাংকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতার কারণে এদের কোনো শাস্তি হয় না। বিশিষ্টজনদের প্রশ্ন, ব্যাংকের টাকা নিয়ে এসব জালিয়াতির শেষ কোথায়। জনগণের আমানতের টাকা এভাবে লুট হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কী হবে। রাষ্ট্র কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে।

সোমবার জাতীয় সংসদে শীর্ষ একশ’ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। অর্থমন্ত্রীর পক্ষে তিনি ওই তালিকা প্রকাশ করেন। তালিকায় ৯৮টি প্রতিষ্ঠান ও দু’জন ব্যক্তির নাম রয়েছে। তবে তালিকায় থাকা বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান অখ্যাত। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের আগে কখনও নামই শোনা যায়নি। এছাড়া এসব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কার কাছে কত ঋণ এবং কত সালে এই ঋণ নিয়েছে, তার বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। অথচ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে চিহ্নিত বড় কয়েকটি গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছে না। কিন্তু খেলাপি ওই তালিকায় তাদের নাম নেই।

সূত্র বলছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে এরা নানা কৌশলে খেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের বাদ রেখেছে। কখনও এরা ঋণ পুনর্গঠন করছে। আবার কখনও আদালত থেকে স্থগিত আদেশ নিয়ে তারা অধরাই থেকে যাচ্ছে। শুধু ব্যাংকে নয়, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতেও জড়িত এই চক্রটি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। না হলে কোনোভাবেই ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা আনা যাবে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সংসদে শীর্ষ একশ’ ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করা হলেও ব্যক্তি বা মালিকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশিত খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই সরকারি ব্যাংকের। এর দায় অর্থমন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। হয় তারা শাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে, না হয় পরোক্ষভাবে খেলাপিদের সহায়তা করছে অর্থমন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, আসলে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ চালু হওয়ার পর থেকে ব্যাংক ডাকাতি বেড়ে গেছে। তার মতে, সরকারি ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে বিভাগটি তুলে দেয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, সরকার এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া কারও পক্ষে কোনো ধরনের জামানতবিহীন ঋণ নেয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এসব ঋণ খেলাপিরাই পুরো ব্যাংকিং খাতকে জিম্মি করে রেখেছে। তার মতে, এ ধরনের ঋণ বিতরণ সাফ জালিয়াতি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, গুটিকয়েক ব্যক্তির কাছে পুরো ব্যাংকিং খাত জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এদের পণ্য বর্জনসহ সামাজিকভাবে এদের বয়কট করতে হবে।

জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ যথেষ্ট নয়। ঋণের টাকা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত মামলাসহ সবগুলো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, খেলাপিদের প্রতিকার করা না গেলে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা বাড়তে থাকবে। তার মতে, সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ আদায়ের জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। এর সঙ্গে জড়িত, যেই হোক তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। কোনোভাবেই একে ছাড় দেয়া যাবে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা অথবা রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে চিহ্নিত খেলাপিদের সরকারের কোনো কোনো মহল থেকে সুরক্ষা দেয়া হয়। এই সুরক্ষা বন্ধ করতে হবে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এদের সামাজিকভাবে বয়কট করা যেতে পারে। তাদের পণ্যও বয়কট করা যেতে পারে। এটি আংশিক পদক্ষেপ। তবে বাস্তবতা হল, ঋণ খেলাপিরা সামাজিক বয়কটের তোয়াক্কা করে না। ফলে সবার আগে সরকারের আইনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। পাশাপাশি যারা এর সঙ্গে জড়িত বা এ ধরনের কেলেংকারি যারা করছেন, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে। তবে তারমতে, তালিকা প্রকাশ ইতিবাচক পদক্ষেপ। কারণ মানুষ জানতে পারল শীর্ষ খেলাপি কারা। এটি এক ধাপ অগ্রগতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ বিতরণের স্থিতি ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও রাইট অফ (অবলোপন) করা হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সবমিলে খেলাপি ঋণের মোট স্থিতি ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১৭ শতাংশ। এরমধ্যে বেশিরভাগ সরকারি ব্যাংকে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এই খেলাপি ঋণের কারণে বিনিয়োগসহ সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটি প্রতিষ্ঠিত। খেলাপি ঋণের জন্যই শিল্প ঋণের সুদের হার কমানো যাচ্ছে না। কারণ এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা থেকে প্রভিশন করতে হয়। তিনি বলেন দীর্ঘদিন পরে হলেও খেলাপিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণ আদায়ে মামলা করাসহ সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাজ সরকারের। খেলাপি যেই হোক সরকারিভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, জামানত ছাড়া যে ব্যাংক ঋণ দিয়েছে, ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কোন বিবেচনায় এত বড় ঋণ দেয়া হল, তা জবাবদিহিতার আওতায় আনতে না পারলে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, খেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করার দাবি আসছে। এটিও এক ধরনের চাপ সৃষ্টি। এতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শীর্ষ খেলাপিদের কাছে যে পরিমাণ অর্থ আছে তা জাতীয় বাজেটের এক চতুর্থাংশ। বিপুল পরিমাণের এ অর্থ আদায়ে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে জামানত জব্দ করতে হবে। যে সব ঋণে জামানত নেই সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খেলাপির সম্পদ জব্দ করা যেতে পারে। এছাড়া আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াসহ বিষয়টি বারবার ফলোআপ করতে হবে। তার মতে, ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা উচিত।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/12/138836