১২ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৩৩

চার বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ১০ হাজার কোটি টাকা

অনিয়মের ঋণ আদায় হচ্ছে না ; ধরাছোঁয়ার বাইরে শীর্ষ ঋণখেলাপিরা

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত চার বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ঋণ অবলোপন করেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সোনালী ব্যাংকের। বিভিন্ন সময় অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলো তা অবলোপন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চিহ্নিত বড় বড় ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ তারা জনগণের আমানতের অর্থবছরের পর বছর আটকে রাখছেন। শীর্ষ এ ঋণখেলাপিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে চলছে।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (নিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেছেন, সোনালী ব্যাংকের ঋণ অবলোপন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো হলমার্ক। হলমার্ক কেলেঙ্কারির প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ অবলোপন করায় সামগ্রিকভাবে বেড়েছে ব্যাংকটির অবলোপনের পরিমাণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৩ সালের শুরুতে সোনালী ব্যাংকের পুঞ্জিভূত ঋণ অবলোপন ছিল তিন হাজার ২৭০ কোটি টাকা। ২০১৬ শেষে তা বেড়ে হয়েছে আট হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটি ঋণ অবলোপন করেছে প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে ১৫৮ শতাংশ।

রূপালী ব্যাংকের গত ডিসেম্বর শেষে পুঞ্জিভূত ঋণ অবলোপন বেড়ে হয়েছে এক হাজার ১৯ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের চার বছরে ঋণ অবলোপন বেড়েছে প্রায় শতভাগ। ২০১৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের পুঞ্জিভূত ঋণ অবলোপন ছিল দুই হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে চার হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটির ঋণ অবলোপন বেড়েছে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের চার বছরে ঋণ অবলোপন বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। ২০১৩ সাল শেষে পুঞ্জিভূত ঋণ অবলোপন ছিল তিন হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঋণ অবলোপন বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা একপর্যায়ে আদায় করতে না পেরে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে অবলোপন করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছর অবলোপনের পরিমাণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মতায় আসার সময় সামগ্রিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ওই সময় পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণ ছিল আরো ১৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃৃত খেলাপি ছিল ৩৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে এ খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ, আর ডিসেম্বরের হিসেবে অবলোপন করা হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকই আলোচনা করেছে ১৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত প্রায় আট বছরে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে শতকরা হিসেবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২০৫ শতাংশ। এর বাইরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই সুবিধা পেয়েছে মূলত বড় খেলাপিরা।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ওই নীতিমালার আওতায় পাঁচ বছর কিংবা তার বেশি সময় ধরে থাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে তা অবলোপন করা হয়। তবে মন্দ মানে খেলাপি অবলোপন করার সুযোগ আছে। ঋণ অবলোপন করতে মামলা থাকতে হয় এবং শতভাগ সঞ্চিতি সংরণ করতে হয়।

আগে মামলা দায়ের না করে ঋণ অবলোপনের কোনো সুযোগ ছিল না। মামলার ব্যয়ের চেয়ে অনেকাংশে বকেয়া ঋণের পরিমাণ কম হওয়ায় মামলা না করেই ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
অবলোপনের পর ঋণ আদায়ে জোরদার ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম থাকলেও ঋণ আদায়ে তৎপরতা দেখা যায় না। এ ছাড়া অনিয়মের ঋণগুলো অবলোপন করে দোষীদের আড়ালও করা হয়।

এসব ঋণ আদায়ের জন্য প্রতিটি ব্যাংকের আলাদা ইউনিট থাকলেও বেশির ভাগ ঋণ আদায় হয় না। যে প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়, তাতে অনেক অস্বচ্ছতা থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক তদবিরে ঋণ দেয়া হয়। আবার অনিয়মও হয় রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে। যেমন হলমার্কে যখন ঋণ দেয়া হয়, তখন সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরিচালক ও ব্যবসায়ীরা। তাদের সামনেই জনগণের অর্থ বের হয়ে যায় সোনালী ব্যাংক থেকে। ওই ঋণ আদায় না হওয়ায় এখন অবলোপন করা হয়েছে; কিন্তু সব দায় এসে পড়ে ব্যাংকারদের ওপর। তিনি বলেন, রাজনৈতিক তদবির যত দিন বন্ধ না হবে তত দিন ঋণ আদায়ও বাড়বে না, দূর হবে না অনিয়ম।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235016