১২ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৩০

বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

চরম দুর্ভোগে পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ

দুর্গম এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার

লালমনিরহাটের বন্যাকবলিত এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে কয়েকটি ভেড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে :নয়া দিগন্ত
দেশের বিভিন্ন জেলায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। অনেক নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকারি ত্রাণ বিতরণ কম হওয়ায় দুর্গম এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে।
বগুড়া অফিস ও সারিয়াকান্দি সংবাদদাতা জানান, অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভারত তিস্তা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেয়ায় বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, যমুনার পানি গত ১২ ঘণ্টায় ১৯ সেন্টিমিটার বেড়ে সারিয়াকান্দি পয়েন্টে মঙ্গলবার বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

যমুনায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সারিয়াকান্দি উপজেলায় আরো ৬টি ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করেছে। এই উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের এক হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে এই উপজেলার অর্ধলাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তবে স্থানীয় হিসাবে এই সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি বলে জানা গেছে। উপজেলার ৫৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের তথ্য মতে, এযাবৎ বন্যার্তদের জন্য ১০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ মেট্রিক টন বিতরণ করা হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। জেলার সোনাতলা এবং ধুনট উপজেলার বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে। তিন উপজেলার কমপে ৭০টি শিাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোর থেকেই বগুড়ায় মুষলধারে বৃষ্টিপাত হওয়ায় শহরের অলিগলি ও নি¤œাঞ্চলে পানি জমেছে। স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। বৃষ্টিতে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। সরকারি ত্রাণসহায়তা অপ্রতুল হওয়ায় অনেকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। বগুড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুজ্জামান জানিয়েছেন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য এখন পর্যন্ত শতাধিক টিউবওয়েল বসানো হয়ছে।
বন্যার্তদের জন্য অপ্রতুল সাহায্য প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার কাছে কেউ রিলিফ চাননি। আমি সরকারি বরাদ্দ এনে তা বিতরণ করছি। সবাই রিলিফ পাচ্ছেন।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৫৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়েছে তিস্তা ও দুধকুমারসহ অন্যান্য নদীর পানি।

বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে জেলার উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের চর ও দ্বীপচরসহ আড়াই শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ। বানভাসি মানুষ বাঁধ ও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। টানা ৫ দিন ধরে বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকা এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট। অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেও তাদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে দিন যাপন করছে। জেলার দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর গ্রামের শেফালী বেগম জানান, ৪ দিন হয় বাড়িতে পানি উঠছে। খুব ¯্রােত পড়ছে। দুইটা বাচ্চা নিয়া সারা দিন মানুষের নৌকায় নৌকায় ঘুরছি। সারা দিন রান্নাও হয় নাই, খাইও নাই। মেম্বার চেয়ারম্যান কোনো রিলিফও দেন নাই।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো: আইয়ুব আলী সরকার জানান, আমার ইউনিয়নের চরাঞ্চলগুলোর ৩০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ জনকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। ৩০ হাজার বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ১১ মেট্রিক টন চাল পেয়েছি। বুধবার বিতরণ করা হবে।
জেলা ত্রাণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, বন্যার্তদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ২৫০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক বন্যাকবলিত মানুষের জন্য তা অপ্রতুল। জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, জেলায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বন্যার পানিতে জেলায় ৭৭১ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে উঠতি আউশ ৭৪ হেক্টর, বীজতলা ১১৩ হেক্টর, সবজি ৩৪৪ হেক্টর, পাট ২ শ’ হেক্টর এবং আখ ৪২ হেক্টর।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৫৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যানুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ১১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৮ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘট নদীর পানি ১৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা, যমুনা ও করতোয়ার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ফুলছড়ি উপজেলার ৩টি শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধসহ চরাঞ্চলবেষ্টিত ৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে বন্যার পানি ওঠায় পাঠদান বিঘিœত হচ্ছে।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ৪ উপজেলার প্রায় ৭৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী। দ্রুত পানি বাড়ায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ দিকে পানির তোড়ে সদর উপজেলার কামারজানি বন্দরের দণি দিকে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০টি ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। শ্রীপুর ও কামারজানি সীমান্তে সরাইল রেগুলেটরটি ভাঙনের মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রেগুলেটরটি রায় ভাঙন এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ব্রহ্মপুত্রের তীরে নিপে করছে।
এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের প থেকে জরুরিভাবে ১শ’ ২৫ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা তিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছ ৫০ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা জানান, সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার পরিবার। ২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে পড়েছে।
সোমবার রাত থেকে চরম অবনতি হয়েছে। উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও শান্তিরাম ইউনিয়নে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। সাতটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উঁচু স্থান এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানিবন্দী পরিবারের অনেক সদস্যরাই ঘরের চালে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়নের আটটি ওয়ার্ডের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ওয়ার্ডের চরাঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ডুবে গেছে।

উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মীর শামছুল আলম জানান, বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠানের পাঠদান আংশিকভাবে চলছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম গোলাম কিবরিয়া জানান, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ২০ মেট্রিক টন চাল এবং দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আজ পানিবন্দী পরিবারগুলোর মধ্যে তা বিতরণ করা হবে।

নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীতে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্ট নদীর পানি বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে করে নদীর তীরবর্তী দু’টি উপজেলার ২৫ গ্রামের ১০ সহ¯্রাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সূত্র জানায়, উজানের ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে সোমবার সকাল ৬টায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্ট বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

দু’দিন ধরে নদীর পানি বাড়ার ফলে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের পাঁচ সহ¯্রাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের নজরুল ইসলাম (৪০) বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ছোটখাতা গ্রামের ছয় শতাধিক বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। পানিবন্দী এসব পরিবার চুলা জ্বালাতে না পেরে দু’দিন ধরে শুকনা খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।

একই ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশপুকুর গ্রামের সমসের আলী বলেন, পূর্ব বাইশপুকুর ও পশ্চিম বাইশপুর গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ওই গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে।
ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, নদীর পানি বাড়ার ফলে ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশপুকুর, পূর্ব বাইশপুকুর, সতিঘাট, সুপুরটারী গ্রামের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। এসব গ্রামের বাড়িঘরে পানি থাকায় দু’দিন ধরে চুলা জ্বালাতে পারছে না পরিবারগুলো। ফলে তারা না খেয়ে দিন কাটাছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধির কারণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আরো পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।
লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, তিস্তা, ধরলা, বুড়ি তিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পানি বাড়ায় জেলায় আবারো বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর ধুবনী গ্রামে সোমবার সকালে একটি বাঁধ ভেঙে গেছে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের দোয়ানী পয়েন্টে সোমবার সকালে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড দোয়ানীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা প্রতি মুহূর্তে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করছি। তিস্তার পানি আরো বাড়তে পারে। বন্যায় চর এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় বন্যায় বেশি ক্ষতি হচ্ছে। পানিবন্দী লোকজনের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ভারত গজলডোবা ব্যারাজের বেশির ভাগগেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। তিস্তা ব্যারাজের বেশির ভাগ গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তার পানিতে পাটগ্রামে অবস্থিত বিলুপ্ত ছিটমহল আঙ্গোরপোতা-দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শোলমারী, জমিরবাড়ি, বইরাতী, আদিতমারী উপজেলার কুঠিপাড়া, গোবর্দ্ধধন, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছা, রাজপুর, তিস্তা, গোকুণ্ড এলাকার চরে ২০ গ্রামের ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার একর আমন ধানের বীজতলাসহ অনেক ফসলি তে ডুবে নষ্ট হচ্ছে। হাতীবান্ধা উপজেলার দক্ষিণ ধুবনী গ্রামের শামসুল হক, শরীফ মোল্লা, আবদুস ছালাম, আবুল কাশেম, নুরল হকসহ অনেক পানিবন্দী পরিবার অভিযোগ করেন, আমরা তিন দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় আছি। এখন পর্যন্ত আমাদের মাঝে কোনো ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। কেউ আমাদের খোঁজ করেনি।

হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু জানান, তার ইউনিয়নের উত্তর ধুবনী গ্রামে একটি বাঁধ ভেঙে বেশ কিছু পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ত্রাণের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন। হাতীবান্ধা উপজেলার সির্ন্দুনা ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, তার ইউনিয়নে ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মো: আলাউদ্দিন খান জানান, ত্রাণের জন্য উচ্চপর্যায়ে আবেদন করা হয়েছে।
ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, ইসলামপুরে বন্যা পরিস্থিতি আবারো অবনতি হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে যমুনার পানি ২৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বেলগাছা উচ্চবিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পড়ে পানিতে ডুবে বেলগাছা গ্রামের বজলুর ছেলে রিপন (১০) নামে এক শিশু মারা গেছে। মঙ্গলবার আশ্রয়কেন্দ্রের পাশের ডোবা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

বন্যায় উপজেলার রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় সদরের সাথে নোয়ার পাড়া, গুঠাইল ও কুলকান্দির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দিন দিন পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেসরকারি হিসাবে বানভাসি মানুষের সংখ্যা দেড় লাধিক অতিক্রম করেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য ও গোখাদ্যের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছায় বানভাসি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিত পাথর্শী ইউপি চেয়ারম্যান ইত্তেখার আলম বাবলু জানান, তার ইউনিয়নের বানভাসিরা এখনো কোন ত্রাণ পাননি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম এহসানুল মামুন জানান, বানভাসিদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ অব্যাহত আছে। ইসলামপুর উপজেলার জন্য ১০ মেট্রিক টন চাল ও ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে যা প্রয়োজনের অতি অল্প বলে জানান এলাকাবাসী। বন্যায় ডুবে যাওয়ায় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শতাধিক শিাপ্রতিষ্ঠান এবং ১০টি কমিউনিটি কিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে উপজেলার যমুনা নদীর অববাহিকার কুলকান্দী, বেলগাছা, চিনাডুলী, সাপধরী, নোয়ারপাড়া,পাথর্শী এবং সদর ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম ডুবে গেছে। ওই সব গ্রামের নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী রোকুনুজ্জামান জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদের অববাহিকায় পলবান্ধা, গোয়ালেরচর, গাইবান্ধা, চর পুটিমারী, চর গোয়ালিনী ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকায় নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে।

উপজেলা শিা অফিস ও মাধ্যমিক শিা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় একাডেমিক ভবন ডুবে যাওয়ায় ৫০টি প্রাথমিক, ১০টি এবতেদায়ি মাদরাসা ও ১২টি মাধ্যমিক স্কুল, ১০টি দাখিল/আলিম মাদরাসায় পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, দেওয়ানগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। উপজেলার দেওয়ানগঞ্জ, চুকাইবাড়ি, চিকাজানী, বাহাদুরাবাদ, হাতিভাঙ্গা, পার রামপুর, চর আমখাওয়া ও ডাংধরা ইউনিয়নের নি¤œœাঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার বেশির ভাগ অফিস প্রাঙ্গণে পানি উঠেছে। উপজেলা পরিষদ-হাসপাতাল-রেলস্টেশন পথে ২-৩ ফিট পানি হওয়ায় চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: নিজামউদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বন্যার্তদের আপদকালীন সময়ে আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার এনামুল হাসান মঙ্গলবার জানান, পাঁচ হাজার ৩৫০ পরিবার পানিবন্দী ও সাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার্তদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চালের পরিমাণ অপ্রতুল বলে ভুক্তভোগীরা জানান। গত সোমবার চুকাইবাড়ি ইউনিয়নের গুজিমারিতে বন্যার্তদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়েছে। চর আমখাওয়া ইউনিয়নে ইসমাইল ও শাহিন নামে দুই শিশু গত রোববার পানিতে পড়ে মারা গেছে।

ওসমানীনগর (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, ওসমানীনগর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার নদীর পানি ধীর গতিতে কমতে শুরু করলেও জলাবদ্ধ এলাকার পানি প্রবাহের গতিপথ উন্মুক্ত না থাকায় বেশির ভাগ এলাকার পানি দ্রুত কমছে না বলে জানা গেছে। তাছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের মধ্যে পানিবাহিত রোগ বালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যাকবলিত রাস্তাঘাট থেকে পানি নেমে যাওয়া শুরু হলেও রাস্তার অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ বরাদ্দ আসছে তা নিতান্তই কম বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তাছাড়া বন্যার শুরুতে গেল বোরো ফসলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বরাদ্দকেও বর্তমানে চলতি বন্যার ত্রাণ বলে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকা দেখলেই লোকজন ত্রাণের নৌকা মনে করে এগিয়ে আসছেন। মহাসড়ক এলাকার আশপাশে ত্রাণ বেশি দিতে দেখা গেলেও বন্যাকবলিত দুর্গম এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কম দেখা যাচ্ছে। এ জন্য দুর্গম এলাকার বন্যাকবলিত লোকজন বেশি কষ্টে আছেন।

বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি ও পানি উঠায় বর্তমানে এলাকায় পানিবাহিত রোগ বাড়ছে। শিশু এবং বৃদ্ধদের মধ্যে এসব পানিবাহিত রোগের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। বন্যাকবলিত গ্রামীণ রাস্তাঘাটে পানি উঠায় রাস্তার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম এলাকার ভেতর দিয়ে কোনো নৌকা গেলেই মানুষ ত্রাণের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের আশপাশ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ বেশি পরিলক্ষিত হলেও বন্যাকবলিত দুর্গম এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করতে কম দেখা গেছে। সাধারণত সমাজের বিত্তশালীরা মহাসড়কের আশপাশ এলাকাতেই বেশি করে ত্রাণ বিতরণ করছেন। কিন্তু উপজেলার পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের বল্লবপুর, সাদীপুর ইউনিয়নের সুরিকোনা, সম্মানপুরসহ দুর্গম এলাকায় বন্যাকবলিত মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। এসব দুর্গম এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হলেও বেসরকারি ত্রাণকার্য অপেক্ষাকৃত কম।

ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান গতকাল জানান, বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে জলাবদ্ধ এলাকার পানি কমে যাবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কিছু দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/234999