গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিকের উদ্যোগে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত আলোচকবৃন্দ
১২ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:২৪

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে আলোচনা করার এখতিয়ার সংসদের নেই

# সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হারাবে -আবুল মকসুদ
# অভিযোগ থাকলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে বিচার হবে -আসিফ নজরুল
# গণভোট ছাড়া সংবিধান সংশোধন নয় -রিজওয়ানা
# এমপিরা নিজেরাই তাঁদের করা আইন মানছেন না -বদিউল আলম
স্টাফ রিপোর্টার : বিচার বিভাগ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করার এখতিয়ার সংসদ সদস্যদের নেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর বিচারপতিদের কটাক্ষ করে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে সংসদ সদস্যরা নিজেদের করা আইনই ভঙ্গ করেছেন। এতে করে বিচার বিভাগ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আয়োজিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক। গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও আইনজীবী জ্যোর্তিময় বড়ুয়া প্রমুখ। গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক।

সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হওয়া বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রোববার জাতীয় সংসদে যে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, এসব আলোচনা করার এখতিয়ার এমপিদের নেই।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রায়ের আলোচনার এখতিয়ার সংসদ সদস্যদের নেই। এটি নিয়ে আলোচনা করে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিয়মকানুন ভঙ্গ করেছেন। তিনি সংসদের ওই আলোচনা ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে সংসদ সদস্যদের দেখার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, তাহলে উপলব্ধি হবে, তাঁরা আসলে কী করেছেন।
তিনি আরও বলেন, বিচারের রায়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির একক সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই ঠিক নয়। এটি আইনের দুর্বল দিক। এটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে সমস্যা কিছুটা কমবে। তবে বিচারবিভাগ নিয়ে এভাবে প্রকাশ্যে আলোচনা করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। এটি সরকার বড় ধরনের ভুল করলো।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, কোনো দেশের বিচারব্যবস্থা সে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বাইরে নয়। এটা সব আমলেই যা ছিল এখনো তা-ই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা এ জন্যই বারবার বলা হয়, যাতে রাষ্ট্রের শক্তিশালী ব্যক্তিটির সঙ্গে সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটিও ন্যায়বিচার পায়।
তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে এভাবে আলোচনা সমালোচনা কোনোভাবেই ঠিক নয়। এতে করে সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগ ওপর আস্থা হারাবে। সাধারণ মানুষ যদি একবার আস্থা হারায় তাহলে দেশের বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। এতে করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।

সাবেক বিচারপতি এবাদুল হক বলেন, বিচার বিভাগের বাজেট ও নিয়োগ প্রধান বিচারপতি হাতে থাকতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। অতীতেও এ ক্ষমতা বিচারপতিদের হাতে ছিল। কিন্তু তাতে তেমন কোনো অসবিধা হয়নি। তাহলে এটি নিয়ে এতো সমালোচনা কেন। আমার বুঝে আসে না।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে তা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে বিচার হবে। এছাড়া কোনো বিষয় হলে তা আদালতে দুই তৃতীয়াংশে ভিত্তিতে আনাস্থা আসতে পারে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বাজেট এবং অনাস্থার ক্ষেত্রে অভিসংশয় থাকতে পারে। সুপ্রিম জুডিসিয়াল বহাল করলে আমাদের তেমন আপত্তি থাকবে না।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, পাঁচ বছরের জন্য জনগণের ম্যানডেট রয়েছে বলেই ক্ষমতায় এসে সংবিধান কাটছাট করবেন, এটি ঠিকনা। সংবিধানের হাত দিতে হলে অনেক মত গণভোটের ব্যবস্থা করা দরকার। সরকার নিজেদের ইচ্ছা মত যখন খুশি সংবিধান সংশোধন করেন। এটি কোনোভাবেই ঠিক নয়। এ নিয়ে আমাদের কথা বলা উচিৎ।
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাদ দেয়ার ভিতরে কি ষড়যন্ত্র আছে আমার বুঝে আসে না। আর এটি নিয়ে সংসদে এতো সমালোচনা করাই বা কি আছে। এটি বাতিল হবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল করলেই চলে। এতে সরকারের নারভাস হওয়ার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।

গোলটেবিলের সঞ্চালক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ৫৩, ৬৩ ও ১৩৩ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যাবে না। এই বিধি সংসদপ্রণীত একটি আইন। সংসদ সদস্যরা নিজরাই তাঁদের করা এই আইন মানেন না। এটা দুঃখজনক।
এদিকে আপিল বিভাগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর সংসদের চলতি অধিবেশনের প্রথম দিনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের নিয়ে সংসদ সদস্যরা আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন দাবি করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে এ দাবি জানান সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
তবে এই সংবাদ সম্মেলনের পর পরই একই স্থানে পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ সভাপতি অজি উল্লাহ।

জয়নুল আবেদীন বলেন, আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়ার পর থেকেই সরকার দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। গত ৯ জুলাই সংসদে সরকার দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রীরা এ রায়ের বিপক্ষে ক্ষোভ প্রকাশ করে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন।
সংসদ সদস্যরা সংসদ পরিচালনার বিধি-বিধান সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন এমন দাবি করে জয়নুল আবেদিন বলেন, যে ব্যক্তি তার সম্পর্কে সমালোচনার জবাব দিতে পারবে না, অর্থাৎ সংসদে উপস্থিত নেই তার সম্পর্কে সংসদে কোনো আলোচনা করা যাবে না।

অথচ সংসদ সদস্যরা দুইজন প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের সম্পর্কে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। যা সুস্পষ্টভাবে আদালত অবমাননার শামিল।
এসব বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে জয়নুল আবেদিন বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত, প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি ও দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সম্পর্কে সংসদে আপত্তিকর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এসব বক্তব্য প্রত্যাহার করতে স্পিকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

এদিকে পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি মো. অজি উল্লাহ বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মামলা চলাকালে এই সংশোধনীর বিষয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সংসদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করেনি, রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেনি। রায়ের গঠনমূলক সমালোচনা কখনোই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়। আর সংসদের ভেতরে আলোচিত কোনো বিষয় নিয়ে সমিতির ব্যানারে সাংবাদিক সম্মেলন করা রাজনেতিক উদ্দেশ্য হাসিল ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই সাংবাদিক সম্মেলনে সমিতির কার্য নির্বাহী কমিটর ছয় সদস্য ছাড়াও আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

http://www.dailysangram.com/post/291281