১২ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:২১

এগিয়ে গেলো অর্ধেক পথ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ায় বড়ই গোস্বা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও তার ঘরজামাই রাজনৈতিক দলগুলো। গত রোববার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে এই রায় নিয়ে অনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম কোর্টের তুমুল সমালোচনা করেছেন। সেই সঙ্গে আদালত কর্তৃক নিয়োজিত সিনিয়র আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরিদেরও তারা তুলোধুনা করে ছেড়েছেন। এই সমালোচনায় সংসদে যারা আছেন, তারা একাট্টা হয়েছিলেন। তারা সবচেয়ে বেশি সমালোচনামুখর হয়েছিলেন দুই সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে। তারা প্রধান বিচারপতিরও কঠোর সমালোচনা করেন। এমনিতেও সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। তার ওপর এই সমালোচনা জানান দিল, বিচার বিভাগকে করায়ত্ত করার জন্য তারা কতোটা মরিয়া। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, এই রায়ের পেছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ রয়েছে।
গত ৭ মার্চ আপিল বিভাগ শুনানিতে প্রবীণ ১২ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন। তাদের মধ্যে দুইজন কোনো মতামত উপস্থাপন করেননি। বাকি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন। এই নয়জন হলেন বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ এফ হাসান আরিফ, এ জে মোহাম্মদ আলী ও এ জে ফারুকী। একমাত্র অ্যামিকাস কিউরি আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। এ ছাড়া আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির সবাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন। আলোচনাকালে সংসদ সদস্যরা হক না-হক অনেক কথাই বলেন। তারা বলেন, এ রায় গণপরিষদের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে প্রণয়ন করা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। এ রায়ের ফলে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়ে যায়নি। তারা বলেন, ৯৬ অনুচ্ছেদ কীভাবে সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা আদালতকে প্রমাণ করতে হবে।

সমালোচনা করেছেন অনেকেই। সমালোচনা করেছেন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে গভীর ষড়যন্ত্র দেখেছেন। মন্ত্রিত্ব-বঞ্চিত শেখ ফজলুল করিম সেলিম ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। তিনি সুপ্রীম কোর্টের এই রায়কে অবৈধ বলে অভিহিত করে উচ্চ আদালতকে নিজ দায়িত্বে রায় পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনি রায় দিয়েছেন, রায় নিয়ে বসে থাকেন। সংসদ এই রায় কার্যকর না করলে কখনও এই রায় কার্যকর হবে না।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা নিজেরা রিভিউ করুন যে, আমাদের ভুল হয়েছে। আপনারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, আপনাদেরই করতে হবে। আমরা করব না।’ শেখ সেলিম অভিযোগ করেন যে, বিচারকেরা মিটিং, মিছিল ও সেমিনারে গিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। বিচারকেরা রাজনীতি করতে পারেন না। যারা বক্তৃতা দিচ্ছেন, তারা সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী উদার। কিন্তু শত্রুকে শত্রু মনে করতে হবে। মিত্র ভাবা যাবে না। তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। বিচারপতি, প্রধান বিচারপতি যেই হোন না কেন, অভিশংসন করতে হবে। রায় দিয়ে ইমপিচমেন্ট ঠেকানো যাবে না।’
ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সমালোচনা করে শেখ সেলিম বলেন, ‘কোথাকার ডাক্তার তিনি। মুরগি, ছাগল না ভেড়ার। কামাল হোসেন প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। আমীর-উল ইসলাম...। কত বড় মোনাফেক, সুবিধাভোগী। মনে করেছে কনফ্লিক্ট লাগাইয়া যদি সুবিধা নেওয়া যায়? পাকিস্তানের চিন্তা-চেতনা আনতে চান? একজনের তো শ্বশুর বাড়ি পাকিস্তানে। মেয়ের জামাই ইহুদি।’ বিচার বিভাগ ও বিচারপতিদের নিয়ে সংসদে আরও অনেক কথাই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, আদালতের হাত সংসদের চেয়ে বড় নয়। বিচারপতিরা কি ভগবান, নিজেই নিজের বিচার করবেন। ইত্যাদি, ইত্যাদি। সংসদে আলোচনার উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘই হলো। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সরকার দলের একটি স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অর্থাৎ সরকার যা বলবে, সেটাই আইন হতে হবে। সরকার যা করবে বিচারপতিদের তাই মেনে নিতে হবে। এ রকম স্বৈরশাসনই এখন বাংলাদেশে চলছে।

এটি এখন আর অস্পষ্ট থাকেনি যে, সরকার তার নিজস্ব স্বার্থ আর অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্যই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করেছিল। সেখানে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি মুখ্য ছিল না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে এখন বিচারকগণ চাকরি হারানোর ভয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারবেন এবং সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো আপোস করতে হবে না। এটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এক বিরাট বিজয়। তবে এই রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ নিশ্চিত করা যায়নি। কিংবা প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণও নিশ্চিত হয়নি। এই রায়ের মাধ্যমে কেবল মাত্র উচ্চ আদালত সরকারের প্রভাবমুক্ত হতে পেরেছে। কিন্তু নিম্ন আদালত রয়ে গেছে সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিয়ন্ত্রণেই। এর ফলে কার্যত বিচার বিভাগ এখন দু’ভাগে বিভক্ত। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়টি সম্পর্কেও বার বার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের দায়িত্বও সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

সরকার দেশকে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুলিশ ও নিম্ন আদালতকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। পুলিশ বিরোধী দলকে দমনের জন্য হেন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেই যা সরকারের নির্দেশে গ্রহণ করছে না। আর নি¤œ আদালত এর যথার্থতা বিবেচনা না করেই পুলিশের দায়ের করা মামলা আমলে নিচ্ছেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানে পুরো বিচার বিভাগের বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করেছিল। অনেকেই মনে করেন, যদি নিম্ন আদালতেরও স্বাধীনতা থাকত তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি দ্রুত প্রভূত উন্নতি হতো।

নিজেদের রক্ষার জন্য যেহেতু সরকার পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর প্রভাব খাটায় এবং অসৎ উদ্দেশে যেনতেন চার্জশিট দাখিল করে দেয়। আর নিম্ন আদালতও তার আমলে নেন। সুতরাং যে কোনো মূল্যেই হোক নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করা অত্যন্ত জরুরি। আর এটা করা সম্ভব হলেই স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়ে উঠবে। বাস্তবতা হলো এই যে শুধুমাত্র বড় বড় মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। কিন্তু লাখ লাখ সাধারণ মানুষের মামলা নি¤œ আদালতেই নিষ্পন্ন হয়। সেখান থেকেই ন্যায় বিচারের জন্য তাদের সুদূর সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আসা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। দশকের পর দশক ধরে বিনাবিচারে কারাগারে আটক থাকেন। তাদের দেখবার কিংবা তাদের জন্য ন্যায় বিচার চাইবার কেউ থাকেন না। মাজদার হোসেন মামলার আলোকে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বিচারকদের সার্ভিস রুলের গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে আসছেন। কিন্তু নানান কৌশলে অ্যাটর্নি জেনারেল কালক্ষেপণ করেই যাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে সরকারের কোনো সদুদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয় না। তবে শুরুর দিকে ষোড়শ সংশোধনী পাস হবার পর প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছিলেন যে, এই রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো যে, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। গত সপ্তাহের মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এও বলেছিলেন যে, এই রায়ের বিরুদ্ধে যেন তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা বেশি বাড়াবাড়ি না করেন। কিন্তু রবিবারের সংসদে আলোচনায় সে বাঁধ ভেঙে গেছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন যে, এ রায়ের মধ্য দিয়ে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করা হলো। তিনি আরো বলেন যে, আসলে এই রায় এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। কেননা, এই রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপিত হয়ে যাবে না। বরং জাতীয় সংসদকেই তা পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ তিনি বলতে চান, যতদিন পর্যন্ত না জাতীয় সংসদ একটি নতুন অ্যাক্টের মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন না করবে ততদিন পর্যন্ত এই শূন্যতা বহালই থাকবে। তবে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছেন যে, অ্যাটর্নি জেনারেলের এই মত ভুল। কারণ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হয়ে যায়। যখন কোনো নতুন আইন বাতিল হয়ে যায় তখন তার পূর্ববর্তী আইন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই বহাল হয়। ড. কামাল হোসেনও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যকে একইভাবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার মুখে রাজনৈতিক বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ৭০ ধারারও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন এই ধারা অনুযায়ী কোনো এমপি পার্টির মতামতের বাইরে ভোট দিতে পারেন না। অর্থাৎ তাদের স্বাধীন মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। ফলে জাতীয় সংসদ একটি খোঁড়া হাঁসে (লেইম ডাক) পরিণত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, এর ফলে বিচারপতিদের ব্যাপারেও সংসদ সদস্যদের নিজস্ব অভিমত দেবার সুযোগ নেই। কার্যত সেই সব দেশে জাতীয় সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা রয়েছে, যেখানে সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। প্রথম কক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে তা আপার হাউজে পাঠায়। আপার হাউজ সে সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে কোনো বিচারপতির অপসারণের সুপারিশ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সে সুযোগ নেই।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের হাতে অর্পণ করেছিল আওয়ামী লীগই। সেখানে প্রেসিডেন্টকে বিচারপতি নিয়োগ ও বরখাস্তের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। বাকশাল রদ হয়ে যাবার পর এই আইন বদলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেভাবেই এতকাল চলে আসছে। এখন হঠাৎ বিচারপতিদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার প্রয়োজন কেন সরকারের পড়লো?

http://www.dailysangram.com/post/291309