১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৯

১২ খাল গেল কোথায়

চট্টগ্রাম মহানগরের মানচিত্র

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ৪৮ বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছিল মাস্টারপ্ল্যান। ১৯৬৯ সালে সেই মাস্টারপ্ল্যানে নগরের ৩৪টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছিল। তবে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে খাল পাওয়া গেছে ২২টি। ৪৮ বছরের ব্যবধানে নগরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ১২টি খাল। অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্বিচারে দখল ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব খাল হারিয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই কোমরপানিতে ডুবছে বন্দরনগরী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই কারণে বিলীন হওয়ার পথে বিদ্যমান খালগুলোও। নতুন ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, এসব খাল পানিপ্রবাহের ক্ষমতা হারিয়েছে ৪২ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়েছে। অতি জোয়ারে নগরের ১৯ শতাংশ কালভার্টের ওপর দিয়েই এখন প্রবাহিত হয় খালের পানি। হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বিদ্যমান খাল, নালা ও নর্দমা নিয়মিত সংস্কার করা হলে জলাবদ্ধতা থেকে অনেকটা রেহাই মিলবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। নগরীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হলেও কোনোটিই বাস্তবায়ন করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ সমকালকে বলেন, পাঁচটি মাস্টারপ্ল্যান হলেও দায়িত্বশীলদের কেউই মহাপরিকল্পনা ধরে সাজাননি শহরকে। এ কারণেই হারিয়ে গেছে ১২টি খাল। এখন বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি একাকার হওয়ায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে পুরো শহর। পরিস্থিতির উত্তরণ করতে হলে আরএস জরিপ (রিভাইজড সার্ভে) অনুযায়ী হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধার করতে হবে। নতুন খাল খনন করতে হবে। নতুন মাস্টারপ্ল্যান ধরে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।


চট্টগ্রাম নগরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান জন আর স্নেল তৈরি করে 'স্টর্ম ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল, মাস্টারপ্ল্যান অ্যান্ড ফিজিবিলিটি রিপোর্ট ফর চিটাগাং'। সেই মাস্টারপ্ল্যানে চট্টগ্রাম শহরের কালুরঘাট থেকে নেভাল একাডেমি পর্যন্ত ৩৪টি খালের

মুখ চিহ্নিত করা হয়েছিল। খালগুলো নগরের বিভিন্ন এলাকায় প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে যুক্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৭২ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ১৯৮৬ সালে লুইস বার্জার, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ১৯৬৯, ১৯৯৫ ও ২০১৭ সালের মাস্টারপ্ল্যানে ছিল নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার বিস্তারিত পরিকল্পনা।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে চিটাগাং ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ওয়াসা। বাংলাদেশ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান অ্যাকোয়া কনসালট্যান্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডবি্লউওএম) সহায়তায় এবং ডেনমার্কের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গ্রন্টমি দুই বছর সমীক্ষা শেষে এ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে। এ সমীক্ষায় মাত্র ২২টি খাল পাওয়া গেছে, ১২টি খালের কোনো অস্তিত্বই পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব খালের বেশিরভাগ হচ্ছে নগরের ফিরিঙ্গিবাজার, ফিশারীঘাট, অভয়মিত্রঘাট, সদরঘাট ও মাঝিরঘাট এলাকায়। আরএস জরিপে এসব খালের অস্তিত্ব থাকলেও পরে জালিয়াতির মাধ্যমে ভিটেবাড়ি দেখিয়ে খালগুলো দখল করা হয়েছে। প্রথমে খালের দুই পাড় দখল করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এরপর খাল সরু হয়ে গেলে ওপরে স্ল্যাব দিয়ে অস্থায়ী স্থাপনা করা হয়েছে। একপর্যায়ে অস্থায়ী স্থাপনার জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নজরদারি না থাকায় রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি খালগুলো।

সর্বশেষ চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান থেকে জানা যায়, নগরের প্রধান খালগুলো ৪২ শতাংশ পানিপ্রবাহের ক্ষমতা হারিয়েছে। ১৯ শতাংশ কালভার্টের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া রাস্তার পাশের ড্রেনের মধ্যে ৩২ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে অথবা কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। মাত্র ৮ শতাংশ ড্রেন পাকা করা হয়েছে। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে রাস্তার পাশের ৯০ শতাংশ বিদ্যমান ড্রেন সংস্কার ও ৫৫ শতাংশ অতিরিক্ত ড্রেন খনন করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। ১৯৯৫ সালে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানে অগ্রাধিকার ছকে ছিল ১০টি এলাকায় পাঁচ পর্যায়ে ড্রেনেজ কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুপারিশ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে এতে তিনটি নতুন খাল ও ৩০টি নতুন সেকেন্ডারি খাল খননের সুপারিশ ছিল। জলাবদ্ধতা নিরসনে তৈরি করা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে মহানগরীর দখল হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক খাল পুনরুদ্ধারের কথা উল্লেখ ছিল।

এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, 'জলাবদ্ধতার সমস্যাটি আমি পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। মাত্র দুই বছর মেয়র পদে আছি। দায়িত্ব নিয়ে ওয়াসার সহায়তায় ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছি। এটি ধরে কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। অতীতে যারা মেয়র ছিলেন, তারা কেন আগের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করে নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করার উদ্যোগ নেননি_ সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে দখলকৃত ও হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধার করতে শিগগির শুরু করব অভিযান।

http://bangla.samakal.net/2017/07/11/306908