১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৭

জাহাজজটে পণ্যজট

চট্টগ্রাম বন্দর

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
এমভি নর্থ টাইগার জাহাজ পণ্যভর্তি কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে গত ২৭ জুন। জাহাজটি এখনও জেটিতে পণ্য খালাসের সুযোগ পায়নি। অপেক্ষার জন্য প্রতিদিন এ জাহাজকে বাড়তি গুনতে হচ্ছে আট লাখ টাকা। শুধু এমভি নর্থ টাইগার নয়, বন্দরে এসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে আরও শতাধিক জাহাজ। প্রতি বছর ঈদের আগে-পরে বন্দরে এমন ভোগান্তি হয়। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান নৌবাণিজ্য সামাল দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই বন্দরে। চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। আমদানি ও রফতানি পণ্যের কনটেইনার রাখার জন্যও নেই পর্যাপ্ত জায়গা। গত ১০ বছরেও নতুন কোনো টার্মিনাল করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই আমদানি একটু বাড়লেই জটিল হয়ে পড়ে পরিস্থি্থতি। বন্দরে জাহাজজট, পণ্যজটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

রোববারের বার্থিং তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে আগামী ১০


দিনে আরও ৩৮টি জাহাজ আসার ঘোষণা রয়েছে। পণ্য খালাসের অপেক্ষায় থাকা ১৩১টি জাহাজের সঙ্গে এসব জাহাজ যোগ হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। বন্দরে ৩৬ হাজার ৩৫৭ কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা থাকলেও এখন ২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার আছে ৩৭ হাজার ৫১৮টি। অর্থাৎ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৮০০ কনটেইনার বেশি আছে। অথচ বন্দরে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে অন্তত ৩০ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়। এ ছাড়া দ্রুত পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকতে হয়। চাহিদার অন্তত ৭০ শতাংশ যন্ত্রপাতি থাকলে বেশি কর্মঘণ্টা ব্যবহার করে কাজ চালানো যায়। অথচ ২০১৬ সালে বন্দর থেকে সরঞ্জাম মিলেছে চাহিদার মাত্র ৫২ শতাংশ। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে যন্ত্রপাতি প্রাপ্তির সুবিধা। ২০১২ সালে ব্যবহারকারীরা চাহিদার ৭৩ শতাংশ যন্ত্রপাতি পেলেও এর পরের চার বছর পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৬৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ৬৫ দশমিক ২৪, ৫৫ দশমিক ২৫ ও ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। ঈদের দিন নামাজ পড়ার সময় ছাড়া পণ্য খালাসে প্রস্তুত থাকি আমরা। তবে পণ্য খালাসে সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ না করায় ঈদের আগে-পরে বন্দরে কিছুটা জট তৈরি হয়। এবার ঈদের সময় সিসিটি টার্মিনালে থাকা দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বিদেশি একটি জাহাজ। এ কারণে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ মারাত্মতভাবে ব্যাহত হচ্ছে।' প্রকৌশল বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, বন্দরে যন্ত্রপাতি কেনার কার্যক্রম নানা কারণে আগে স্থবির হয়ে থাকলেও সম্প্রতি এক হাজার ১২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।

শুল্কায়নে সময় নিচ্ছে কাস্টমসও :এ দিকে ১০ থেকে ১২ দিন অপেক্ষা করে বন্দরে পণ্য খালাসের পর শুল্কায়নের জন্য ফের অপেক্ষা করতে হয় ব্যবসায়ীদের। বন্দরে মাত্র পাঁচটি স্ক্যানার আছে। অথচ বছরে প্রায় ২৪ লাখ কনটেইনার ও সাত কোটি টনেরও বেশি পণ্য ওঠা-নামা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। কাস্টমসে নেই দক্ষ জনবলও। তাই পণ্যের পরীক্ষা করতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। আধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম কম থাকায় কিছু কিছু পণ্য শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মেশিনপত্র ও গার্মেন্টের বিভিন্ন সামগ্রী এভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে আরও পাঁচ-ছয়দিন বাড়তি সময় ব্যয় হয় কাস্টমসে। এ প্রসঙ্গে ইস্টার্ন গ্রুপের স্বত্বাধিকারী ও বিজিএমইর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'বন্দরে পণ্য খালাস করতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় বাড়তি লাগছে এখন। আবার কাস্টমসে বাড়তি সময় লাগে আরও ৭-৮ দিন। এভাবে আমদানি পণ্য ১৫ দিন বন্দর এলাকায় পড়ে থাকায় সময় মতো রফতানি পণ্য দিতে পারছি না বিদেশি ক্রেতাদের।'

বাড়ছে অপেক্ষমাণ সময় ও ব্যয় :এদিকে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় বন্দরে ক্রমেই বাড়ছে জাহাজের অপেক্ষার সময়। ২০১২ সালে কনটেইনারে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজকে গড়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে তিন দশমিক ২৩ দিন। এর পরের তিন বছরে অপেক্ষার এ সময় ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩৯, ৩ দশমিক ১৬, ৩ দশমিক ৯৯ দিন। ২০১৬ সালে অপেক্ষার এ সময় আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক ০২ দিন। কার্গো পণ্য নিয়ে আসা জাহাজের ক্ষেত্রেও চিত্র অভিন্ন। ২০১২ সালে কার্গো পণ্য নিয়ে আসা জাহাজকে গড়ে ৬ দশমিক ৩০ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে অপেক্ষা করতে হয়েছে যথাক্রমে পাঁচ দশমিক ৯৪, পাঁচ দশমিক ১১ ও পাঁচ দশমিক ৩০ দিন। ২০১৬ সালে কার্গো জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় ছিল পাঁচ দশমিক ৩০ দিন। চট্টগ্রাম বন্দরসীমায় পণ্য খালাস থেকে শুরু করে বন্দর ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সময়কে ডুয়েল টাইম ধরা হয়। বন্দরে জেটি এলাকায় জেনারেল কার্গোর ডুয়েল টাইম নির্ধারণ করা আছে সর্বোচ্চ ২২ দিন। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বন্দরের ভেতরে পণ্য থাকার ডুয়েল টাইম ছিল যথাক্রমে ২১ দশমিক ৬৮, ২২ দশমিক ২৪, ২১ দশমিক ৮৪, ২২ দশমিক ৮৭ ও ৩৮ দশমিক ৬২ দিন। তবে কনটেইনারবাহী জাহাজের ডুয়েল টাইম ১৫ দিন নির্ধারিত থাকলেও ২০১৬ সালে তা ছিল ১১ দশমিক ৫৪ দিন।

ব্যবহারকারীরা যা বলেন :পণ্য খালাস প্রসঙ্গে পোর্ট ইউজার্স ফোরামের চেয়ারম্যান মাহাবুবুল আলম বলেন, দেশের অর্থনীতির প্রাণ বলা হয় চট্টগ্রাম বন্দরকে। তবে সক্ষমতা বাড়ছে না বন্দরের। যে পরিমাণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ লোকবল দরকার তা নেই। বন্দরে বাণিজ্য ক্রমেই বাড়লেও কমছে সক্ষমতা। শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরে যে যন্ত্রপাতি দিয়ে কনটেইনার ও কার্গো পণ্য ওঠা-নামা করা হচ্ছে, তা আধুনিক কোনো বন্দরে নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে বন্দর কর্তৃপক্ষকে স্বচ্ছতা রেখে দ্রুত সংগ্রহ করতে হবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।' জুনিয়র চেম্বার চট্টগ্রামের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, 'বন্দর কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেওয়ার পরও আমলতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এতদিন যন্ত্রপাতি সংগ্রহে গতি আসেনি। এর খেসারত দিতে হচ্ছে এখন।'

http://bangla.samakal.net/2017/07/11/307052