১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৫

৫৫৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ এক বছরেও শুরু হয়নি

দীর্ঘ একযুগ ধরে জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে অমানবিক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ডিএনডির কয়েক লাখ মানুষ। এবারও পোহাচ্ছে। পানিতে তলিয়ে আছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, সবজি ক্ষেত, নার্সারি। প্রায় ২৫ লাখ মানুষ অধ্যুষিত ডিএনডি বাঁধের ভেতর প্রতি বছরের এ চিত্র পত্রিকার শিরোনাম হলেও টনক নড়ে না সংশ্লিষ্টদের। তাদের উদাসীনতা ভুক্তভোগীদের ক্ষুব্ধ করে তুললেও যেন কিছু যায় আসে না। তবে ডিএনডি বাঁধ সংস্কার এবং ভেতরের জলাবদ্ধতা দূর করার লক্ষ্যে গত বছরের ৯ই আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। ৫৫৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর আগামী বর্ষায় ডিএনডি বাঁধ এলাকায় জলাবদ্ধতা কমে আসবে। তবে পুরো ফল পাওয়া যাবে তিন বছর পর কাজ শেষ হলে। এমনটাই বলা হচ্ছে। কিন্তু বর্ষার আগে প্রকল্প পাস হলেও কাজ শুরু হয়নি প্রায় এক বছরেও। যদিও ২০১০ সালে ডিএনডির জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার ২৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু ৬ বছরেও ওই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।

জলাবদ্ধতার নেপথ্যে: ডিএনডিতে জলাবদ্ধতার নেপথ্যে নানা কারণের মধ্যে অন্যতম অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, জলাধার বিলীন, অতিরিক্ত বর্জ্য, খাল পুনঃখনন না করা, খাল দখল, পানি আটকিয়ে মাছের চাষ, মেয়াদ উত্তীর্ণ নিষ্কাশন পাম্প ও পর্যাপ্ত পাম্প না থাকা। ফলে অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ডিএনডি প্রজেক্টের ভেতরের পানি সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলস্থ পাম্প হাউজের ৩০০ হর্স পাওয়ারের ৪টি পাম্প দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়। প্রতিটি পাম্প সেকেন্ডে ১২৮ কিউসেক (ঘনফুট) পানি নিষ্কাশন করে। ৪টি পাম্প সেকেন্ডে ৫১২ কিউসেক পানি নিষ্কাশন করার কথা থাকলেও পাম্পগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ ও অতি পুরনো হওয়ায় ৪টি পাম্প মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কিউসেক পানি নিষ্কাশন করতে পারছে। তাও আবার শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন সেচ খালে ফেলায় এক সঙ্গে ৪টি পাম্প চালানোও সম্ভব হয় না। ফলে এটাও জলাবদ্ধতার কারণ। সূত্রমতে, রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারীদের সতেজ রবি শস্য সরবরাহ করার জন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা এলাকার ৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমি নিয়ে ১৯৬৫ সালে ইরিগেশন প্রকল্প তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। যা ১৯৬৮ সালে বাস্তবায়ন করা হয়। নাম রাখা হয় ডিএনডি বাঁধ (ইরিগেশন প্রকল্প)। প্রকল্প বাঁধের দৈর্ঘ্য ৩২ দশমিক ৮ বর্গ কিলোমিটার। এ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে তৎকালীন সময় ২৩৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বর্তমান ঢাকা-৪ ও ৫ এবং নারায়ণগঞ্জ-৪ সংসদীয় আসন এলাকার কিছু অংশ নিয়ে ডিএনডি সেচ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। এর অভ্যন্তরে ৫ হাজার ৬৪ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এনে ইরি ধান চাষের উপযোগী করা হয়। এসব এলাকায় পানি সেচ দেয়া ও নিষ্কাশনের জন্য সবচেয়ে বড় ‘কংস নদ’ নামে একটি প্রশস্ত খাল ছিল। এ খালের সঙ্গে আরো ৯টি শাখা খাল ছাড়াও ২১০টি আউটলেক, ১০টি নিষ্কাশন খাল ছিল। এসব খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৬ কিলোমিটার। এরমধ্যে নিষ্কাশন খালের দৈর্ঘ্য ৪৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার আর ইরিগেশন খালের দৈর্ঘ্য ৫১ দশমিক ২০ কিলোমিটার। ২টি প্রধান পানি নিষ্কাশনের খাল কাটা হয় প্রথম পর্যায়ে ৫৫ পয়েন্ট ২০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৫ পয়েন্ট ৪০ কিলোমিটার। এবং ২টি প্রধান সেচ খাল কাটা হয় প্রথম পর্যায়ে ১৪১০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৪ কিলোমিটার। খরা মৌসুমে জমিতে পানি সেচ দিতে ও বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন করতে সরকার এ খালগুলো তৈরি করে। কিন্তু কংস নদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। ওই নদ দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় সারা দেশ যখন পানিতে ভাসছিল তখন ডিএনডি বাঁধ অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ না করায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন ডিএনডিতে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা অপরিকল্পিত ভাবে নির্মাণ করতে থাকে। দিনে দিনে ডিএনডি প্রজেক্ট আবাসিক এলাকায় পরিণত হতে থাকে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সকল সেচ কার্যক্রম, সৃষ্টি হতে থাকে জলাবদ্ধতার। তাই শুধু বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের কাজে ব্যবহৃত হয় ডিএনডি পাম্প। ডিএনডি অভ্যন্তরে অপরিকল্পিত ভাবে প্রচুর পরিমাণে বাড়িঘর নির্মাণ করায় অতিরিক্ত পানি ও বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ২০০৪ সালে আকস্মিক ভাবে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ৪৫ দিন কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে অমানবিক দুর্ভোগ পোহায়। এরপর টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের। ফলে ২০১০ সালে সরকার ২৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকার শিমরাইল ও আদমজী এলাকায় ২টি পাম্পস্টেশন স্থাপন, ফতুল্লার পাগলা ও ফতুল্লা এলাকায় ২টি পাম্পিং পয়েন্ট স্থাপন, ১৪৫টি কালভার্ট, ১৫০টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৯৪ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃখনন এবং খালের পাড় নির্মাণ, অবৈধ দখল ঠেকাতে ৬০ কিলোমিটার খালের দুই পাড় গ্রিল দিয়ে ঘেরাও এবং ৯ দশমিক ২৫ কিলোমিটার খালের দেয়াল উঁচু করা। প্রকল্পটি আলোর মুখ না দেখায় ডিএনডিবাসী রেহাই পায়নি জলাবদ্ধতা থেকে।

৫৫৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ এক বছরেও শুরু হয়নি: পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)’র তথ্যমতে, ডিএনডি বাঁধ সংস্কার এবং ভেতরের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য গত বছরের ৯ই আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। ৫৫৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর আগামী বর্ষায় ডিএনডি বাঁধ এলাকায় জলাবদ্ধতা কমে আসবে। তবে পুরো ফল পাওয়া যাবে তিন বছর পর কাজ শেষ হলে। কিন্তু প্রায় এক বছরেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। পাউবোর ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ জানান, কাজ শুরুর পর আগামী বর্ষার আগেই কিছু অগ্রগতি আশা করা যায়। তবে পুরো ফল পাওয়া যাবে কাজ শেষ হলে। তিনি জানান, বাঁধের ভেতর ১০ শতাংশ জায়গা রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। তবে সেখানে অপরিকল্পিত বাড়িগুলো প্রকল্পের কাজে খুব প্রভাব ফেলবে না। তারপরও রাজউক এবং ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় থাকবে। এই প্রকল্পের আওতায় দুটি নতুন পাম্প হাউস করা হবে। একটি পাম্প হাউস আদমজীনগরে এবং আরেকটি হবে শিমরাইলে পুরনো পাম্প হাউসের পাশে। এছাড়া শিমরাইলে ৭টি, আদমজীনগরে ৬টি, শ্যামপুরে ২টি, পাগলায় ১০টি ও ফতুল্লায় ছোট-বড় ১২টি পাম্প স্টেশন বসানো হবে। এসব পাম্প হাউস ও স্টেশন বসানোর পর শুরু হবে বাঁধের ভেতরে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল সংস্কারের কাজ।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=73436&cat=6