১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৪

কুয়েতের শ্রমবাজার নিয়ে নানা শঙ্কা

আট বছর কুয়েতের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার বন্ধ ছিল। কুয়েতে ২০০৮ সালে শ্রমিক ধর্মঘটসহ বাংলাদেশি শ্রমিকদের উচ্চ অপরাধের হারের কারণে শ্রমিক ভিসা স্থগিত ছিল। গেল বছরের মার্চ মাসে কুয়েত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব লেফটেন্যান্ট  জেনারেল সুলাইমান আল-ফাহাদ বাংলাদেশ সফর করেন। এরপর একই বছরের জুনে কুয়েতে শ্রমবাজার আবার খুলেছে। কিন্তু চিহ্নিত দালাল চক্রের কারসাজির কারণে কুয়েতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার আবার নষ্ট হতে চলেছে। এ জন্য দায়ী একটি শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেট ভিসা বাণিজ্য করে চলেছে। এসব নানা কারণে কুয়েতের শ্রমবাজার নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর গত দুই বছরে ৫০ হাজার বাংলাদেশি নতুন ভিসা নিয়ে কুয়েতে গেছেন। প্রথমদিকে দালালরা কুয়েতে পাঠানোর জন্য জনপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিতেন। কিন্তু বর্তমানে নিচ্ছেন সাত লাখ টাকা। এর কম হলে কাউকে পাঠাচ্ছেন না। বগুড়ার আকাশ প্রধান কুয়েত থেকে মানবজমিনকে বলেন, দালালের মাধ্যমে সাড়ে ছয় লাখ টাকায় কুয়েত এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আমাকে যে কাজ দেয়া হয়েছে তাতে খুশি হতে পারছি না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কুয়েতে শ্রমিক পাঠানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। ফলে কুয়েতে যেতে ভিসার জন্য আকাশচুম্বী মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। এদিকে ভিসার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করছেন। এসব মধ্যস্থতাকারীরা জানেন না কোন কোম্পানি থেকে কি ধরনের ভিসা বের হচ্ছে, কি ধরনের কাজ এবং বেতন কত। ফলে এসব ভিসায় যাওয়ার পর নানা সমস্যার মুখে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। কুয়েতে ভিসা দালালির সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কুয়েতের যেকোনো কোম্পানি থেকে একটি ভিসা বের করতে এক লাখ টাকা খরচ হয়। এরপর বাংলাদেশের কোনো এজেন্সির কাছে ওই ভিসা কয়েক গুণ মূল্যে বিক্রি করা হয়। এরপর এজেন্সি থেকে দালালরা কয়েক গুণ মূল্যে কিনে তা নিরীহ মানুষদের কাছে বিক্রি করেন। কুয়েতে বসবাসরত প্রবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কুয়েতে এখন চলছে জমজমাট ‘ভিসা’ ব্যবসা। চুক্তি অনুযায়ী বেতন ঠিকভাবে দেয়া হয় না এমন কোম্পানির ভিসা উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে চিহ্নিত দালাল চক্র। অনেক কোম্পানিতে কাজ নেই তবুও ওই সব কোম্পানির ভিসাও বের করছে চক্রটি। এসব ভিসায় বাংলাদেশিরা কুয়েতে যাওয়ার পর নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বস্ব খুইয়ে বাংলাদেশিরা কুয়েতে গিয়ে কাজকর্মের পর বেতন না পেয়ে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। সর্বশেষ গেল মাসের শেষদিকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় এখনো আট জন জেলে আছেন। নড়াইলের মহসিন মানবজমিনকে বলেন, ছয় মাস আগে ক্লিনিং কোম্পানিতে কাজ নিয়ে কুয়েত এসেছি। এ জন্য লেগেছে ছয় লাখ টাকা। ক্লিনিং কোম্পানিতে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করে মাসে বেতন পাচ্ছি ৬০ দিনার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ১৫ হাজার টাকার কিছু বেশি। দেশে দেনা করে এসেছি তাই এ টাকায় চলবে না। এ জন্য বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করছি। মহসিন জানান, আমরা এক সঙ্গে ১২ জন নতুন ভিসায় কুয়েতে এসেছি। কয়েকজন মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকলেও বেশির ভাগের অবস্থা করুণ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভিসা নিয়ে কুয়েতে বাংলাদেশি দালালদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। কোনো এক কোম্পানিতে ভিসার জন্য এক ব্যবসায়ী কন্ট্রাক করে আসার পর আরেক ব্যবসায়ী ওই ভিসা কেনার জন্য মূল্য বাড়িয়ে দেয়। তবে ভিসা বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ভিসা বের হয়ে বাংলাদেশে আসার পর এনিয়ে রীতিমতো হুড়োহুড়ি শুরু হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করে ভিসা নিয়ে যেসব শ্রমিক কুয়েত যান তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা খুব বেশি হয় না। কারণ সত্যায়িত করার আগে দূতাবাস ওই কোম্পানির সুযোগ-সুবিধা, বাসস্থানসহ নানা বিষয় খোঁজখবর নেন। ফলে দূতাবাস ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন। তবে দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়া অনেকে ভিসা পেয়ে বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে যান। কোম্পানিতে কোনো ধরনের ঝামেলা হলে তখন দূতাবাস কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে না। এদিকে পাশের দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে ঘটনা পুরো উল্টো। কারণ ওই সব দেশের সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে শ্রমিকরা কম বেতনে কুয়েত আসেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কুয়েত থেকে রেমিট্যান্স আসা কমছে। নানা কারণে এ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংক এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ১১০৬ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ১০৭৭ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১০৩৯ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে কুয়েত থেকে। ওই হিসাবে ২০১৫ সালে ২৯ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার, ২০১৬ সালে ৩৭ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স কমেছে। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর পর্যালোচনা করলেও রেমিট্যান্স কমার চিত্র দেখা যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের মুল্যবৃদ্ধি, প্রবাসী শ্রমিকদের ওভারটাইম কমে যাওয়া এবং আকামা নবায়ন সহ বিভিন্ন কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=73521&cat=2