১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১২

নিষিদ্ধ ১০ কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ

সুন্দরবন ঘেঁষে হানিফের চিংড়িঘের

সুন্দরবনের পাশে ১০ কিমি এলাকায় (মানচিত্রের লাল অংশ) শিল্প ও ভারী অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ। খুলনার দাকোপ উপজেলা তার মধ্যে পড়েছে। মাহবুব উল আলম হানিফের এই ঘেরটি সেই এলাকায় স্থাপিত l প্রথম আলোসুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ও স্থাপনা নির্মাণ আইনে নিষিদ্ধ হলেও এই এলাকার ভেতরে ৩৫ একর জমিতে একটি চিংড়ির খামার প্রতিষ্ঠা করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। সুন্দরবনের এক কিলোমিটার সীমানার মধ্যে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নে ওই খামারের মধ্যে একটি দোতলা ও একটি একতলা ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী চিংড়িঘের তৈরির জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করা এবং এর ভিত্তিতে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও এই চিংড়িঘেরের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। গত বছর থেকে এটি বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে।

খামারের সীমানার মধ্যে আগে থেকে একটি পুকুর ও কালীমন্দির ছিল। পুকুরটি ইতিমধ্যে ভরাট করা হয়েছে। ঘের স্থাপনের জন্য বেড়িবাঁধ কেটে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদ থেকে লবণপানি তোলা হয়েছে।
মাহবুব উল আলম হানিফের মালিকানাধীন কোয়েস্ট অ্যাকুয়াকালচার ও ফিশ প্রসেসিংস লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) যৌথভাবে এই খামার স্থাপন করেছে বলে খামারের প্রধান ফটকের সাইনবোর্ডে দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই দুই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমমূলধনি তহবিল (ইইএফ) থেকে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, কোয়েস্টের খামারে অর্থায়ন বরাদ্দ হলেও তা এখনো বিতরণ করা হয়নি।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার এলাকায় সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভূমিরূপের পরিবর্তন হয় এমন কোনো স্থাপনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড যাতে না করা হয়, সে জন্য সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকায় ১৫টি বড় সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ওই এলাকায় অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত কার্যক্রমগুলো না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হাবিবুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ একরের ওপরে চিংড়িঘেরের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বেশির ভাগ চিংড়িঘের তা নেয় না। কোয়েস্ট অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড ফিশারিজ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, চিংড়িঘেরের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রের দরকার হয় এমন কোনো নিয়ম তাঁর জানা নাই। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই খামারটি
করা হয়েছে আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য। ওই এলাকায় কোনো ঘের এ ধরনের ছাড়পত্র নেয় বলে আমার জানা নাই। ঘেরটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যাঁদের হাতে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হয়তো এটা জানতেন না। তবে আমি তাঁদের বলেছি, তাঁরা যাতে পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য আবেদন করে।’

পুকুর ভরাট ও কালীমন্দিরের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে হানিফ বলেন, ‘ওই মন্দিরের জমিটি আমরা ইজারা নিয়েছি। খামারের বাইরে আমরা আরেকটি মন্দির বানিয়ে দিচ্ছি। আর আগে যে পুকুরটি ছিল, তাতে গুইসাপ ও নানা পোকামাকড় থাকত। তাই ওই পানি বিশুদ্ধ ছিল না। আমরা গ্রামের মানুষের জন্য একটি পানি পরিশোধনযন্ত্র স্থাপন করে দিয়েছি। সেখান থেকে দিনে ৫ হাজার লিটার পানি গ্রামবাসীদের সরবরাহ করা হচ্ছে। আর নতুন মন্দিরের ছাদ ঢালাই চলছে, খুব দ্রুত আগের মন্দিরের পূজা কমিটির সদস্যদের দিয়ে তা উদ্বোধন করানো হবে।’
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৫ ধারাবলে সরকার ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি সরকার সুন্দরবনের ইসিএ এলাকার স্থলভাগের সীমানা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে। হানিফের খামারের স্থান, অর্থাৎ খুলনার দাকোপ উপজেলাও নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে রয়েছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ইসতিয়াক আহমেদ গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো ধরনের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি আমরা দিচ্ছি না। সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য এটা করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে ২০১৬ সালের আগস্টে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ইসিএ এলাকায় স্থাপিত শিল্পকারখানা ও স্থাপনার একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তাতে দাকোপ উপজেলায় স্থাপিত ৩৪টি শিল্পকারখানা ও স্থাপনার নাম রয়েছে। সেখানে চারটি চিংড়িঘের ও হ্যাচারির নাম রয়েছে। কিন্তু মাহবুবুল আলম হানিফের চিংড়ির খামারের নামের উল্লেখ নেই।
জেনারেটরের বিকট আওয়াজ

গত জুনে চিংড়ি খামার পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা গেল, ঘেরের চারপাশে প্রায় আট ফুট উচ্চতার সীমানাপ্রাচীর ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। ঘেরের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে সেখানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে। সুতারখালী বন ফাঁড়ির উল্টো পাশের ওই ঘেরে দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সেটি চালানো হয়। এতে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এই এলাকায় বিকট শব্দের সৃষ্টি হয় বলে জানান স্থানীয় ব্যক্তিরা।
চিংড়ির খামারটির মূল ফটকের দেয়ালে হানিফ ও খুলনা জেলা শ্রমিক লীগের সহসভাপতি মো. ফরিদ আহমেদের পক্ষ থেকে দাকোপবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি পোস্টার সাঁটানো।
খামারের ভেতরে প্রবেশ করতেই নিরাপত্তারক্ষীরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি জানতে চান। খামারটি সম্পর্কে জানার আগ্রহের বিষয় তুলে ধরলে খুলনা জেলা শ্রমিক লীগের সহসভাপতি মো. ফরিদ আহমেদ বেরিয়ে আসেন। বলেন, তিনিই এই খামার দেখাশোনা করেন। পরিবেশ ছাড়পত্র না নেওয়া এবং ইসিএ এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিংড়িঘের করতে এসব কিছুর দরকার হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবির অর্থায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে কোয়েস্ট অ্যাকুয়াকালচারের মহাব্যবস্থাপক মাহবুব উল আলম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইইএফ তহবিল পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। খুব শিগগির আমরা তহবিলের প্রথম কিস্তির টাকা পেয়ে যাব। এ কারণে অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়টি বলা হয়েছে।’
২০১২ সালে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ চিংড়ির চাষ নিয়ে একটি রায় দেন। তাতে বলা হয়, চিংড়ির চাষ পরিবেশবান্ধব কোনো কার্যক্রম নয়, এটি পরিবেশের শত্রু। তাই চিংড়িঘের করতে হলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হবে। নিতে হবে পরিবেশ ছাড়পত্র। বনভূমির ক্ষতি করে কোনো চিংড়িঘের করা যাবে না।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো জলাশয় ভরাট করা যাবে না। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী বন্য প্রাণীর বসতি আছে এমন কোনো স্থানের প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বন্য প্রাণী অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি আমরা ইতিমধ্যে করে ফেলেছি। আর কোনো ক্ষতি হোক এমন কিছু করা ঠিক হবে না। এই বনের পাশে চিংড়িঘেরসহ নানা শিল্পকারখানা যদি এভাবে হতে থাকে, তাহলে সুন্দরবনকে আমরা আরও দ্রুত হারিয়ে ফেলব।’ তিনি বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশে অনেক আইন আছে। এখন আইনপ্রণেতারা যদি আইন ভাঙেন, তাহলে কীভাবে সুন্দরবন রক্ষা পাবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1246386