১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১১

বেলার তথ্য

পূর্বাচলে হাজার একর বনভূমি কেটে প্লট–ফ্ল্যাট হচ্ছে

গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বড়কাউ মৌজায় গাছ কেটে এবং উঁচু–নিচু লালমাটির ভূপ্রকৃতি কেটে সমান করা হচ্ছে। সেখানে ফেলা হচ্ছে বালু l ছবি : প্রথম আলোপূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লট বানাতে ভাওয়ালগড়ের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা হচ্ছে। গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বড়কাউ ও পারাবর্ত মৌজার লালমাটির উঁচু–নিচু ভূমি কেটে সমান করা হচ্ছে। কেটে ফেলা হচ্ছে সেখানকার বনভূমি। প্লটের জন্য উপযোগী করতে অর্থাৎ সমান করতে ওই ভূমিতে ফেলা হচ্ছে বালুর আবরণ। গত চার বছরে ওই এলাকায় ছয়বার পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিবারই এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সর্বশেষ গত মাসের (জুন) শেষ সপ্তাহেও ছিল একই চিত্র।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে দেওয়া পূর্বাচল প্রকল্পেরতথ্য বিশ্লেষণ করেবাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বলছে, পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা ১ হাজার ৩০০ একর জমির বেশির ভাগ শাল ও অন্যান্য বৃক্ষে আচ্ছাদিত। এর ৬৭৭ একরের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এলাকায় ছিল বৃক্ষরাজি; যা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন হিসেবে চিহ্নিত।এখানে শুধু দুই মৌজায় ২ হাজার প্লট তৈরি করতে ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ গাছ কাটা হচ্ছে।
১৯৫৯ সালের ব্যক্তিগত বন আইন অনুযায়ী, ওই ৬৭৭ একর ভূখণ্ড ব্যক্তিগত বন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ বন আইন অনুযায়ী কমপক্ষে অর্ধ হেক্টর ভূমির অন্তত ১০ শতাংশ এলাকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃক্ষ থাকলে তাকে বন বলা যায়। তবে ওই এলাকার বৃক্ষের উচ্চতা কমপক্ষে পাঁচ মিটার হতে হবে। বন বিভাগ পূর্বাঞ্চলে বড়কাউ, পারাবর্ত মৌজাসহ মোট পাঁচটি মৌজাকে বন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ অনুযায়ী আবাসন প্রকল্প একটি লাল তালিকাভুক্ত কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ এটি মারাত্মক পরিবেশদূষণকারী। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী আবাসন প্রকল্প করতে হলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হবে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের জন্য ইআইএ ও পরিবেশ ছাড়পত্র কোনোটাই নেওয়া হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ২ ফেব্রুয়ারি বেলার করা আবেদন নিষ্পত্তি করে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, রাজউককে পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হবে। রাজউক যে লে-আউট প্ল্যান করেছে, সেটা মানা হলে প্রচুর গাছ কাটা পড়বে, যা চলতে দেওয়া যায় না।
পূর্বাচল প্রকল্পভুক্ত এলাকা গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ গ্রামের বাসিন্দা উম্মে কুলসুমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য তাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তবে এখনো তাঁরা নিজেদের ভিটায় আছেন। তাঁদের জমিতে আম-কাঁঠালের বাগান ছিল, তা কেটে নিয়ে গেছে ঠিকাদারের লোকেরা। সন্ত্রাসী দিয়ে এলাকা ছাড়ার জন্য ভয় দেখানো হচ্ছে।
তবে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের উদ্যোক্তা রাজউক সরকার ও আদালতে দেওয়া তথ্যে বলেছে, ওই গাছগুলো বনভূমির নয়। এগুলো ঘরের আশপাশে জন্মানো লতাগুল্ম বা হোমস্টেড ভেজিটেশন। এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুসন্ধান শেষে এক প্রতিবেদনে বলেছে, পারাবর্ত ও বড়কাউ মৌজার ৮০ শতাংশ এলাকাতেই শালজাতীয় গাছ রয়েছে।
এ ব্যাপারে সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্বাচল প্রকল্পে যে পাঁচটি মৌজায় ব্যক্তিগত বন ছিল, তা নিয়ে আমরা বন আইনে মামলা করেছিলাম। আর শালগাছ কাটতে হলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন লাগে।’ পূর্বাচল প্রকল্পে বিপুল পরিমাণে শালগাছ বিনা অনুমতিতে কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি এই সরকারের আমলেই যুক্ত করা হয়েছে। পরিবেশ ও জলাভূমি সংরক্ষণ আইনও করেছে এই সরকার। কিন্তু রাজউক পূর্বাচল প্রকল্প করতে গিয়ে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জলাভূমি ধ্বংস করছে। এতে অন্য ভূমিদস্যুরা আইন অমান্য করে পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপারে উৎসাহিত হচ্ছে।
বড়কাউ জামে মসজিদের পাশ দিয়ে কিছুদূর এগোতেই শিকড়সুদ্ধ তুলে ফেলা একটিশতবর্ষী শালগাছের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখা গেল। গুঁড়িটি ছয় ফুটের কম নয়। গাছের ওপরের অংশ কেটে নেওয়া হয়েছে। গুঁড়িটির দিকে তাকাতে তাকাতে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় অধিবাসী শাহজাহান মাস্টার।
গাছ ও মাটি দেখিয়ে তিনি বললেন, একেকটা গাছ শত বছরের স্মৃতি। অথচ সরকার গুটিকয়েক শহুরে মানুষকে সুবিধা দিতে হাজার বছরে গড়ে ওঠা পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।
বড়কাউ ও পারাবর্ত মৌজার ১ হাজার ৩০০ একর এলাকাকে পূর্বাচল প্রকল্প থেকে বাদ দিয়ে বন প্রতিবেশব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করতে আটটি সংগঠনের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। সংগঠনগুলো ওই ১ হাজার ৩০০ একর জমিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করার আবেদন করে। সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বেলা, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্মস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), নিজেরা করি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পের বৃক্ষের সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়ে তা আদালতে হাজির করেছে। উচ্চ আদালত থেকে পূর্বাচল প্রকল্পের কোনো গাছ ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজউক তা মানছে না। উল্টো প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করছেই। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের রায় অবমাননা করছে।
রাজউকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পূর্বাচল দেশের সবচেয়ে বড় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। ৬ হাজার ১৫০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত ওই প্রকল্পে ২৬ হাজার প্লট ও ৬২ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি করা হচ্ছে। প্রায় ২৩ বছর ধরে এ প্রকল্পের কাজ চলছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1246466