১০ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ৬:০৭

সিন্ডিকেটের কবলে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

প্রাথমিকে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি বইয়ের জন্য সরকারের প্রাক্কলিত বরাদ্দ রয়েছে ২৭৭ কোটি টাকা। অথচ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ১৮% কম মূল্যে ২৩৭ কোটি টাকার এ কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। দেশীয় ৩২টি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে ৪০ কোটি টাকা কম দামে কাজ পেলেও দরপত্র অনুযায়ী বইয়ের মান রক্ষা করা যাবে কী না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এজন্য আগেই নিম্ন মানের কাজ ঠেকাতে কঠোর মনিটরিং করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় পাঠ্যত্রুম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রয়োজনে টাস্কর্ফোস গঠন করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এদিকে মুদ্রণ শিল্প সমিতির একাধিক নেতারাও নিম্ন মানের বই ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন। তাদের দাবি, সবাই কম দামে বই নেয়নি। যারা বাজার দরের অস্বাভাবিক কম দরে কাজ নিয়েছে তারা নিম্নমানের কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের জন্য গোঠা শিল্পকে বিতর্কিত হতে দেয়া যাবে না। এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে প্রাথমিকের বইয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী এবার ভারত ও চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে ঠিকতে পারেনি। ২০১৫ সালে একই কায়দায় ভারত ও চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে হঠিয়ে সর্বনিম্ন মানের দরদাতা হিসেবে কাজ পায় দেশীয় ২২টি প্রতিষ্ঠান।

এনসিটিবি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান বাজারদর পর্যালোচনা করে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ২৭৭ কোটি টাকা প্রাক্কলিত দরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু ৩২টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান ১৮% কম দামে ২৩৭ কোটি টাকায় কাজ পায়। অর্থাৎ সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৪০ কোটি টাকা কম দামে কাজ বাগিয়ে নেন তারা। প্রাথমিকের দরপত্রে ভারত, চীনের একাধিক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত তারা ঠিকতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের ছাড়পত্র পাওয়ার পর প্রাথমিকের পাণ্ডুলিপি সিডি আকারে বিতরণ করার প্রত্রিুয়া শুরু করেছে এনসিটিবি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ঠিকাদার নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়েছে। এখনই বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য টাস্কর্ফোস গঠন করা হবে। তারা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিষয়টি তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়ের খান মানবজমিনকে বলেন, সবাই যে ১৮% কম দামে কাজ পেয়েছে বিষয়টি এমন নয়। অনেকেই প্রাক্কলিত দরের সমান দামে কাজ পেয়েছে। কেউ ১৮%, কেউ আবার ৩০% কম দামেও কাজ পেয়েছে। যে ৩০% কম দামে কাজ পেয়েছে সে কীভাবে কাজের মান ঠিক রাখবে সেটার দেখার বিষয়। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী, এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবহিত করে চিঠি দিয়েছি। সেখানে আমরা প্রতিযোগিতা করে কাজ করতে চাই, তবে নিম্নমানের কাজ নয়। যারা প্রতি বছর এ ধরনের গর্বিত কাজ করে তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার জন্য বলেছি। এক দু’জনের পুরো শিল্প এর দায়ভার নিবে কেন এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পুরো সিন্ডিকেটের সঙ্গে চারটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। তারা বিদেশি ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে হঠাতে অস্বাভাবিক এই কম দামে কাজ নিয়েছে। গেল বছর সময় মতো বই না দেয়ার তাদের প্রায় ৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করেছে এনসিটিবি। ২০১৫ সালে নিম্নমানের বই দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

এ ব্যাপারে আনন্দ প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী রাব্বানী জব্বাব মানবজমিনকে বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আমরা কাজ পেয়েছি এটা সত্য। তবে এ কাজ পেতে শুধু যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে তা না দেশি অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও করতে হয়েছে। সর্বনিম্ন দামে কাজ নিলেই যে মান রক্ষা হবে না এটা মনে করা ঠিক না। কারণ দরপত্রে সেই মানের কথা বলা হয়েছে, সেটা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। এছাড়া আমাদের মনিটরিং করার জন্য সরকার ও এনসিটিবির একাধিক সংস্থা কাজ করে। তাদের চোখ ফাঁকি দেয়ার এতো সহজ না। সব মিলিয়ে আমরা দেশি প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মহৎ একটি কাজ সফল করতে কাজ করছি। আশা করি এবার পুরোপুরি মান রক্ষা করা সম্ভব।

জানা গেছে, এবার প্রাথমিকে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪০টি বই ছাপার জন্য দরপত্রে বলা হয়েছে। ৯৮টি লটের মধ্যে ৯২টি লটের সম্মতি দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। বাকি ৬টি সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দরদাতাকে কাজ দেয়ার আপত্তি তুলেছেন বিশ্ব ব্যাংক। কেন সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়া হয়নি তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=73368