১০ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৪০

ভিন্ন রূপে থাকছে ৫৭ ধারা, তবে সাজা কমছে

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হলেও প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’ ভিন্ন রূপে এর বিষয়বস্তু থাকছেই। এমনকি আইসিটি আইনের এই ধারা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধারায় অপরাধ হলে মামলা হবে, ইতিমধ্যে দায়ের হওয়া মামলার বিচারও চলবে।

সম্প্রতি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই এই ধারায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০টির বেশি মামলা হয়েছে। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল এই ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও একাধিকবার বলেছেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা থাকবে না। নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে, ওই আইনে ৫৭ ধারার বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে।

কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে গতকাল রোববার আইন মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় মতবিনিময় হলেও সেখানে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সভা শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, আগস্টে আরেকটি সভা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সভায় উপস্থিত আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এ সময় ৫৭ ধারা রাখা না-রাখা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কোনো না কোনোভাবে এই ধারা রাখার পক্ষে মত দেওয়া হয়। তবে আইনমন্ত্রীসহ উপস্থিত অনেকেই ৫৭ ধারা এখন যেভাবে আছে, তার বিপক্ষে মত দেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা
রহিত (বাতিল) করতে বলা হয়েছে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ১৯ ধারায় প্রকারান্তরে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখা হয়েছে। তবে ওই ধারায় অপরাধের সাজা কমানোর প্রস্তাব আছে। আইসিটি আইনে ৫৭ ধারার অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ১৯ ধারার (একই ধরনের অপরাধ) অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর ও সর্বনিম্ন দুই মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মতো ঢালাও অভিযোগের পরিবর্তে প্রস্তাবিত ১৯ ধারায় বিষয়টি ব্যাখ্যা দিয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপরাধগুলো যেখানে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য ছিল, সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ১৯ ধারার অপরাধগুলো অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুই আইনেরই উদ্যোক্তা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। জানতে চাইলে এই বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু আইনের খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং করছে, সুতরাং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারাই দেবে।

গতকালের মতবিনিময় সভায় উপস্থিত আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যে আলোচনা হয়েছে তাতে তাঁর মনে হয়েছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হচ্ছে। তবে এটা কীভাবে, কতটুকু থাকছে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

সভা শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, গতকালের সভায় যেসব বিষয় আলোচনা হয়েছে, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে এনে খসড়ায় যুক্ত করা হবে। এ নিয়ে আগামী আগস্ট মাসে আবার সভা করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধারা (৫৭ ধারা) আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধারায় অপরাধের জন্য মামলা হবে। কিন্তু মামলা হওয়াটাই শেষ নয়। মামলা দায়েরের পর অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে একটা তদন্ত হয়। সেই তদন্ত অত্যন্ত সুষ্ঠু হবে, সেটা আপনাদের আশ্বস্ত করছি।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার পাশাপাশি ৫৪, ৫৫ ও ৫৬ ধারা রহিত হবে এবং এই চার ধারার অধীন গৃহীত পদক্ষেপ এই আইনের (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) অধীন গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ৫৭ ধারা যদি বাতিল করা হয়, তখন যেসব মামলা হয়েছে সে ব্যাপারে নতুন আইন করার সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ৫৭ ধারায় এখন যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো আদালতের এবং তদন্তের এখতিয়ারে রয়েছে। তবে কোনো মতেই নির্দোষ কেউ যাতে সাজা না পায় বা হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলে আসছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি হলে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা থাকবে না। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কার্য হবে একটি অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ১৯ ধারায় এই বিষয়গুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখা হয়েছে।

গতকালের সভায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ ২১টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1245331