১০ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:১৬

চিকুনগুনিয়ার দাপটে কাবু অনেকেই

চিকুনগুনিয়া এডিস মশাবাহিত ভাইরাস রোগ। এ মশা দিনের বেলা বিশেষত সকাল ও সন্ধ্যার সময় কামড়ায় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। মানুষের দেহে এর সংক্রমণ ঘটলে প্রচণ্ড জ্বর ওঠে । ১০৪-৫ ডিগ্রি অবধি তাপমাত্রা গড়ায়। গা ব্যথা করে। এ রোগের এখনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এমনিতেই এ জ্বর সেরে যায় সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে। তবে জটিল আকার ধারণ করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় রোগীকে। তীব্র জ্বরে রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা সাধারণ ব্যথানাশক প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন।

চিকুনগুনিয়া জ্বর সেরে গেলেও পরবর্তী ধকল সামলাতে দুই-তিন মাস লেগে যায়। রোগীর গিরায় গিরায় প্রচ- ব্যথা হতে থাকে। ওঠাবসা ও হাঁটাচলায় মারাত্মক সমস্যা হয়। অর্থাৎ অনেকে কর্মক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। কাজেই এ রোগকে খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই।

চিকুনগুনিয়া আমাদের দেশে নতুন রোগ। এর প্রাদুর্ভাব ঘটে প্রথমে আফ্রিকায়। তারপর নানা দেশ ঘুরে ভারত হয়ে আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে এর অনুপ্রবেশ ঘটে। ধীরে ধীরে রোগটি মহানগরী ঢাকাসহ সারাদেশকে গ্রাস করতে বসেছে। রাজধানীর ঘরে ঘরে এ রোগ ঢুকে পড়েছে প্রায়। সব বাড়িতে দুই-তিনজন করে চিকুনগুনিয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে বলে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার খবরে প্রকাশ।

আমার এক আত্মীয়কে কয়েক মাস আগে দিল্লি গিয়ে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল অনিবার্য কারণে। সেখানে তিনি এ রোগে ভোগেন। এই আত্মীয় এখন স্পেনে। কিন্তু চিকুনগুনিয়ার জের অর্থাৎ জয়েন্টের পেইন এখনও তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

'চিকুনগুনিয়া' নাম শুনে 'চিকন চিকন' বা হাল্কা হাল্কা মনে হলেও এর ধকল কিন্তু মোটেও চিকন বা হাল্কা নয়। দুর্ভোগ পোহাতে হয় দীর্ঘদিন। আমাদের অফিসের কয়েকজন তরুণ সহকর্মী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন। শরীরের তাপমাত্রা কমলেও ধকল যাচ্ছে না। ভোগাচ্ছে। গিরার ব্যথায় ককিয়ে উঠছেন জোয়ান মানুষ। এ রোগের এমনই দাপট। খাতির নেই বুড়ো আর জোয়ান বলে। কাজেই এ রোগে যাতে না পায় সেরকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অলসতা করে মশারি না খাটিয়ে শোয়া যাবে না। দিনে ঘুমোলেও মশারি টাঙাতে হবে। ঘরে যাতে মশা না ঢুকতে পারে সেব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে বর্ষাকালে বেশি। এখন পুরো বর্ষা মওসুম। প্রতিদিন বৃষ্টিপাত হচ্ছে। খাল-বিল, ডোবা-নালা ভরে যাচ্ছে। ফুলের টব, প্লাস্টিকের ডিব্বা, খানাখন্দকে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। তারপর ডিম ফুটে লার্ভা বড় হলেই বসতবাড়িতে গিয়ে মশা ঢোকে।

সেদিন এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসতে হাসতে এক টিভি চ্যানেলে বললেন, এডিস মশা নাকি কুলীন। এরা বিল্ডিংবাড়ির কোণা-কাণায় থাকতে পছন্দ করে। কামড়ায়ও বড়লোকদের বেশি। ডাক্তারসাহেবের কথা শুনে অনেকে হাসলেও ঘটনা কিন্তু সত্যি তাই। গ্রামাঞ্চলে চিকুনগুনিয়ার দাপট কিছুটা কমই। এডিস মশা বড়লোকের রক্তপান করতে পছন্দ করে। তাইবলে গরিব লোককে ফুটপাত কিংবা দালানের বারান্দায় খালিগায়ে পেলে কিন্তু ছেড়ে দেয় না মোটেও।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকবে। এ সময়তক সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশামারবার ওষুধ ছেটাতে হবে নিয়মিত। যেখানে সেখানে ডিব্বা, ভাঙা বোতল, মাটির খলা, ডাবের খোসা ইত্যাদি যেন পড়ে না থাকে। কারণ এসবে পানি জমে থাকে। মশা ডিম পাড়ে এগুলোয়।

মশানিধন সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকনকে তৎপর দেখা গেলেও উত্তরের মেয়র আনিস সাহেবকে তেমনটি দেখা যায়নি। তবে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এমন এলাকা হিসেবে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অনেক জায়গার নাম রয়েছে। আমরা জানি না, তিনি চুপচাপ কেন? তবে কি তিনি গভীর রাতে ফগার মেশিন দিয়ে এডিসনিধনের ব্যবস্থা করেছেন? মনে হয় না। কারণ ফগারের যে গর্জন, তাতেতো ঘুমন্ত মানুষেরও জেগে যাবার কথা। কিন্তু কই, এমন আলামত তো পাওয়া যাচ্ছে না?

চিকুনগুনিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকায়। এ পর্যন্ত রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এ পরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের মধ্যে ৫১৩ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে মাত্র। তবে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি। উল্লেখ্য, একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে দ্রুত পরিবারের অন্যদের শরীরে বাসাবাঁধে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক এ ব্যাধি। কিন্তু রোগের উপসর্গ দেখেও অনেকেই যাননি পরীক্ষা করাতে। তাই সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কারুর কাছেই নেই প্রকৃত সংখ্যা। এজন্য আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নির্ধারণে জরিপ শুরু করেছে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা একটি দৈনিককে জানান, গত তিন মাসে ৬৪৩ জনের রক্ত ও লালার নমুনা পরীক্ষা করে ৫১৩ জনের চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি জানান, দেশে একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানেই চিকুনগুনিয়া শনাক্তের প্রযুক্তি আছে।

চিকুনগুনিয়া যখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানে এ রোগনির্ণয়ের প্রযুক্তি থাকবার খবরটি উদ্বেগজনক। তাই অনতিবিলম্বে এ রোগনির্ণয়ের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আনবার ব্যবস্থা করতে হবে আরও অনেক হাসপাতালের জন্য। অন্যথায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। অতএব এ ব্যাপারে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধিকর্তাদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

http://www.dailysangram.com/post/291038