৯ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১২:৫০

এমপিও নীতিমালায় আসছে ব্যাপক পরিবর্তন

জনবল কাঠামো ও শিক্ষক প্যাটার্নে পরিবর্তন হবে; কঠিন হচ্ছে এমপিও প্রাপ্তি ও ভুক্তি

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের সরকারি অংশ বা মান্থলি পে-অর্ডারের (এমপিও’র) বিদ্যমান নীতিমালা ও এর নির্দেশনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। এমপিওর জনবল কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশ করা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষক প্যাটার্নে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে। এ ছাড়া এমপিও প্রাপ্তির শর্তের মধ্যে নতুন ও কঠিন বেশ কিছু শর্তযুক্ত হচ্ছে। সাধারণ শর্তাবফলতেও সংশোধন-সংযোজন আনা হচ্ছে। এসব সংশোধনী ও পরিবর্তনের প্রস্তাব ও সুপারিশ করতে যাচ্ছে বিদ্যমান এমপিও নীতিমালা ও নির্দেশনা সংশোধন সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কমিটি। এ কমিটি আগামীকাল রোববার এক বৈঠকে উপরিউক্ত প্রস্তাবনা ও সুপারিশ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ওই সংশোধনী ও পরিবর্তনের প্রস্তাব ও সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে নি¤œ-মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার গুণগত মান অনেকটাই নিশ্চিত হবে।

ওই প্রস্তাবনা ও সুপারিশ এ বৈঠকের পরই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। অর্থাৎ সচিব ও পরে মন্ত্রীর অনুমোদনের পর ওই (এমপিও) নীতিমালা ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সংশ্লেষ থাকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে না। সেখানে অনুমোদন পাওয়া গেলেই কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে। ওই প্রজ্ঞাপনের আলোকেই আগামীতে নতুন করে এমপিওভুক্তিসহ এ সংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।

বিদ্যমান এমপিও নীতিমালার দুইটি অংশÑ একটি জনবল অংশ এবং অপরটি হচ্ছে এমপিও-তে অন্তর্ভুক্তি এবং বাদ দেয়ার শর্তাবলি। সংশোধন কমিটি এ দুইটির ব্যাপক সংশোধন ও পরিবর্তনের সুপারিশ করতে যাচ্ছে। ১৯৯৪ সালে এমপিওর জন্য বিদ্যমান জনবল কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়। এখন পর্যন্ত ওই জনবল কাঠামোর কিছু সংশোধন হলেও বড় ধরনের কোনো সংশোধন হয়নি। বর্তমান সরকারের বিগত আমলে (২০১০ সালে) সর্বশেষ যে এমপিও দেয়া হয়েছিল, তখন বিতর্ক শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন রাজনৈতিক ও শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোর বেশ কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করা হলেও সেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন ওই সংশোধন কমিটির এক সদস্য।

জনবল কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের যে সুপারিশ করা হচ্ছে, তা হবেÑ বিদ্যমান নীতিমালায় প্রতিটি নি¤œ-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে একজন করে শিক্ষক রয়েছেন। নতুন প্রস্তাবনা ও সুপারিশে ইংরেজি বিষয়ে পৃথক একজন করে শিক্ষক থাকবেন এবং তাকে নিয়োগের সুযোগ থাকবে। তিনি নতুন করে এমপিওভুক্ত হবেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি গত কয়েক বছর আগে নি¤œ-মাধ্যমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো শিক্ষক নেই। এখানেও দেশের সব বেসরকারি স্কুল-কলেজে একজন করে আইসিটি শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তিনিও এমপিওভুক্ত হবেন। এ ছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান ও ভৌত বিজ্ঞানে যেমন, রসায়ন ও জীব বিজ্ঞানের জন্যও আলাদা শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এসব বিষয়ের জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের এমপিও-তে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ও সুপারিশ করা হচ্ছে।

সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ২৬ হাজারের বেশি এমপিভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ-মাদরাসা) রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই বিষয়ভিত্তিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের মান আগের চেয়ে অবশ্যই বাড়বে ও উন্নত হবে বলে মনে করেন জনবল কাঠামো সংশোধন ও সুপারিশ কমিটির এক সদস্য। যিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এ মন্তব্য করেন।

তিনি আরো বলেন, এমপিও নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঘোরতর আপত্তির পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধির স্বার্থে জনবল আরো বৃদ্ধির এ প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিওর সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষক সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় এক লাখের কাছাকাছি। তাদের সাথে নতুন করে যুক্ত হবে প্রতি স্কুলে ইংরেজি ও আইসিটির জন্য পৃথক একজন করে শিক্ষক।

এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশ কিছু শর্ত ও যোগ্যতা পূরণ করতে হয়। এখানেও সংশোধন আনা হচ্ছে। নতুন প্রস্তাবনা ও সুপারিশে শিক্ষকদের বয়সের বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় আনা হবে। শিক্ষকের বয়স নির্ধারণ করে দেয়া হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন শর্তারোপ করা হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনার জন্য এসব শর্তযুক্ত করা হচ্ছে। শিক্ষকতা অভিজ্ঞতার চেয়ে শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে বিবেচনায় নেয়া হবে। এ ছাড়া এমপিওভুক্তির সাধারণ শর্তাবলিতেও সংশোধন আনা হচ্ছে। এমপিও বাদ দেয়ার শর্তাবলিতে বেশ কিছু নতুন বিষয় বিশেষ করে শিক্ষকদের আচরণগত ও কোচিং বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ততাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

পরিবর্তন ও সংশোধন কমিটি জানায়, এমপিও নীতিমালা ও নির্দেশনা নিয়ে শিক্ষকদের কথায় কথায় উচ্চাদালতে রিট করার ও মামলা করার যে সুযোগ ছিল তা রহিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কমিটির অপর এক সদস্য নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে শিক্ষা আইন না থাকার সুযোগ নিতেন শিক্ষকেরা। এমপিওভুক্তির নীতিমালা ও নির্দেশনার বিষয়গুলোতে শিক্ষা আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। শিক্ষা আইনও বর্তমানে চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে। আইনের খসড়া চূড়ান্ত প্রায়। ফলে আটঘাট বেঁধেই সব করতে যাচ্ছে সরকার।

এ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নতুন অর্থ বছরের (২০১৭-১৮) জাতীয় বাজেটে এমপিওভুক্তি খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকায় সরকারের বর্তমান মেয়াদে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সম্ভাবনা অনেকটাই নেই। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন বিবেচনায় রেখে এবং সরকারদলীয় এমপিদের চাহিদা ও দাবির ভিত্তিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশেষ বিবেচনায় এ খাতে থোক বরাদ্দ দেয়া হলেই কেবল নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হতে পারে। এ সম্ভাবনা অনেকাংশেই নেই বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছে। এমপিওর বিদ্যমান নীতিমালা ও এর নির্দেশনায় ব্যাপক পরিবর্তনের যে সুপারিশ করা হচ্ছে, তা অনুমোদন পেলে এ বছরই কয়েক হাজার নতুন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান এতে যুক্ত না হলেও একসাথে নতুন করে কয়েক হাজার শিক্ষক সরকারের এ সুবিধাভোগী হবেন। এর ফলে সরকারের ওপর চাপ অনেক কমবে।

এমপিও নীতিমালা ও নির্দেশনা সংশোধন সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এ কমিটির সাথে যুক্ত এক অতিরিক্ত সচিব নয়া দিগন্তকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমনিতেই প্রচণ্ড বিরক্ত এবং এর ঘোর বিরোধী। নতুন নির্দেশনা ও নীতিমালা তিনি কিভাবে নেবেন তার ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে এর (নতুন এমপিওভুক্তির) ভবিষ্যৎ। এরপরও এমপিভুক্তি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এ নিয়ে অনেকটাই সুবিবেচনা রয়েছে। এটিই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য আশার আলো। এরই ভিত্তিতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনার আলোকে ২০১৫ সালে গঠিত ‘এমপিও নির্দেশনা-নীতিমালা সংশোধন কমিটি’ দফায় দফায় বৈঠকের পর বৈঠক করে নানা দিক ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করেছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/234172