৯ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১২:১০

বিরোধীদলকে অবরুদ্ধ রেখে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘটা করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছে। দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী দেশে-বিদেশে নৌকার পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপিসহ বিরোধী জোটকেও তিনি নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি দল যখন সর্বত্র নির্বাচনের কথা বলছে, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ২০ দলীয় জোটকে গত কয়েকবছর ধরে সভা-সমাবেশই করতে দেয়া হচ্ছে না। পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঘরোয়া আলোচনার আয়োজন করা হলে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি পবিত্র মাহে রমযানে ইফতার মাহফিল পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। বলতে গেলে বিরোধীদল আজ অবরুদ্ধ। অন্যদিকে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজারের বেশী মামলা চলমান। বিএনপি প্রধান ও জোটের শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মামলায় পর্যুদস্ত করা হচ্ছে। প্রতিসপ্তাহে তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া বিরোধী নেতাদের সবার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে, মুখে নির্বাচনের কথা বললেও মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচন করার ইচ্ছে নেই। আর যদি নির্বাচন করেও সেটিতে বিএনপিসহ সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার ইচ্ছা নেই। তারা বলছেন, নির্বাচনের মাত্র বছর দেড়েক সময় রয়েছে। অথচ এখানে বিরোধী জোটের মৌলিক ও মানবিক অধিকার অনুপস্থিত। সরকার এদের মাঠেই নামতে দিচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এ প্রতিবেদককে বলেন, নির্বাচন মানে ক্ষমতা। ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। তিনি বলেন, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সবার আগে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সে কাজটি যদি রাজনৈতিক দলগুলো সঠিকভাবে না করতে পারে, তাহলে নির্বাচন হওয়া না হওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। আবুল মকসুদ মনে করেন, সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা না দেয় তাহলে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। আর যদি সরকার একতরফা নির্বাচন করতে চায় তাহলে সে নির্বাচন কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিরোধী জোটের কর্মকা-ে বাধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবুল মকসুদ সম্প্রতি রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপি মহাসচিবের উপর হামলার বিষয়টি টেনে আনেন। তিনি বলেন, এভাবে রাস্তা আটকে কারো ওপর হামলা রীতিমতো গু-ামি ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবে চলতে থাকলে তো বিরোধী দলগুলো নির্বাচনেও নামতে পারবে না।

নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমরা সব সময় নির্বাচনের পক্ষে। আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ কোথায়? তিনি বলেন, সরকারি দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে কর্মীরাও নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়েছেন। আসলে তারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায় না। তারা মুখে নির্বাচনের ধুয়া তোলার চেষ্টা করছে। একটা আবহ তৈরি করতে চাচ্ছে। কিন্তু অন্য দিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলকে সুযোগ সুবিধা ভোগ করার যে অধিকার দিতে হবে তার কোন লক্ষণই দেখছি না। উপরন্তু আমরা দেখছি যারা ভিন্নমত পোষণ করছে, সরকারের কাজের সমালোচনা করে তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন আরো বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে না এবং এটা তারা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছে বলেও দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব। তিন বলেন, আর ক্ষমতায় না আসতে পারলে কী হবে তা তাদের সাধারণ সম্পাদক বলে দিয়েছেন। আমি আর বলতে চাই না। সে জন্যই তারা আবারও অবৈধভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে চায়। তিনি বলেন, সরকার মুখে নির্বাচনের কথা বললেও দেশে সেরকম কোনো পরিবেশ তৈরী হয়নি। আমাদের চেয়ারপার্সনসহ দলের সিনিয়র নেতারা মামলার জালে বন্দী। প্রতিনিয়ত সবাইকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। গুম, হামলা-মামলা অব্যাহত রেখে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।

সরকার মুখে নির্বাচনের কথা বললেও বাস্তবে সেটি মানে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নির্বাচনের মূল স্তম্ভ হলো গণতন্ত্র, সবাইকে সভা-সমাবেশের সুযোগ দেয়া। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকা। কিন্তু এসবের কোন কিছুই দেশে বর্তমান নেই। তারা এখন একদলীয় শাসন চালাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের জোটগত দলগুলো যখন তখন রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশ করলেও বিরোধী পক্ষের জন্য সেটি যেন ‘হারাম’। দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম দল বিএনপি বারবার তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হবে বলে ঘোষণা দিলেও সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাতে বর্বর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে সমাবেশ করার উপর নিষেধাজ্ঞা চলছে। এছাড়া দেশের আরেক জনপ্রিয় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকেও দীর্ঘ ৭/৮ বছর ধরে রাজনৈতিক কর্মকা-ে বাধা দেয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উপর সরকারের দমনপীড়ন চোখে পড়ার মত। দলটির অভিযোগ, তাদের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে মিথ্যা অভিযোগ এনে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এমনিতেই দলটি কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারছে না। দেশব্যাপী তাদের অফিসগুলোও বন্ধ। কেন্দ্রীয় নেতারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। যারা বাইরে আছেন তাদের অধিকাংশই এখানে- সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারের রোষানলে পড়ে পরিবারগুলোও এখন অসহায়। জামায়াত-শিবিরের উপর সরকারের এমন কুনজর ছিল যে, দেখামাত্রই তাদের গুলীর নির্দেশনা ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি। অভিযোগে প্রকাশ, সরকার শুধু জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের দমন পীড়ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, যে কোনো ঘটনা ঘটলেই তদন্তের আগেই তার দায়ভার সংগঠনগুলোর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। সারা দেশে এখন দুটো আইন। আওয়ামী লীগের জন্য একটি আর অন্য সবার জন্য আরেকটি। তারা ভিন্নমতের জনসভা বা মতামত সহ্য করতে চান না। এর কারণ আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, এই সরকার নিজেরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা করে না। তিনি বলেন, শুধু বিএনপি নয়, সব বিরোধী দল ও মতকে রাজপথে নামতে দেয় না এ সরকার।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ‘শোডাউন’ দেখতে চান না সরকারের হাইকমা-। বিএনপি যাতে রাজধানীর উন্মুক্ত স্থানে কোনো সমাবেশ, মানববন্ধন বা র‌্যালির আয়োজন করতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাপক লোক সমাগম আয়োজনের অনুমতি সহ্য করা হবে না। এমনকি ঘরোয়া আয়োজনেও আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারের ধারণা, বিএনপি রাজধানীতে সমাবেশ করতে পারলে দলটির নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠবে। একইভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে আবারো বেগবান করে তুলবে।

সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন থেকে। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী বছরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এ নিয়ে চলছে ব্যাপক তোড়জোড়ও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ কিছুদিন থেকেই নৌকার পক্ষে ভোট চাইছে। দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন। তাদের এমন বক্তব্যে এখন একটি বিষয়ই আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলো-দেশে কি নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে? ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও অনেক পিছিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারাও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। একইসঙ্গে দলটির নেতারা বলছেন, তারা ক্ষমতাসীনদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। এমনকি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনও হতে দিবে না বলে তারা -ঁশিয়ারি দিয়েছেন।

এদিকে নির্বাচন নিয়ে জনগণ মনে হয় অনেকাংশেই নির্বিকার। হয়তো কিছুটা আতঙ্কিতও। তারা নির্বাচনের আগে কোনো হানাহানি দেখতে চান না। তারা চান ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল। দেশের সকল নাগরিক মুখিয়ে আছেন নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য। এজন্য তারা স্বপ্নে বিভোর। সবার আশা, অচিরেই দেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও সুস্থ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দেশ পরিচালনায় তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবেন। নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশে গণতন্ত্রের সত্যিকার বহিঃপ্রকাশ চান তারা। কিন্তু সরকার যেভাবে বিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন এবং রাজনৈতিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে তাতে নির্বাচন নিয়ে সবাই শঙ্কিত।

দেশের প্রায় সব ক’টি দল, সুশীল সমাজ এমনকি বিদেশীরা পর্যন্ত বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চান। তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেভাবে সরকারি দলের একগুয়েমী বক্তব্য চলছে তাতে করে জনমনে শংকা তৈরি হচ্ছে এই জন্য যে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে, নাকি আবারো একটি একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রহসন ঘটবে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, একটি অংশগ্রহণমূলক অর্থপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান জাতির আকাক্সক্ষা ও দেশের স্বার্থেই জরুরি।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতির নির্বাহী পরিচালক শারমিন মোরশেদ বলেন, আমি এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে চাইব, এমনভাবে একটি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হোক যেখানে দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে। জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে নিশ্চয় সরকার ওয়াকিবহাল। তারা চাইবে না আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেটা আরো ঘনীভূত হোক।

 

http://www.dailysangram.com/post/290885