৯ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১২:০৬

ভারতের নন-ট্যারিফ বাধায় বাংলাদেশের ঘাটতি ৪৭৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও তেমন সুফল পায়নি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। উল্টো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ওপর ডাম্পিং এর অভিযোগ আনে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। অথচ বৈধ-অবৈধ পথে ভারত থেকে নি¤œমানের পণ্যের আমদানি ঘটায় এদেশের বাজার দখল করে রেখেছে প্রতিবেশি দেশটি। অশুল্ক বাধার কারণেই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ৪ হাজার ৭৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

একক দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। দেশের আন্তর্জাতিক মোট বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ ভারতের সঙ্গেই হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি আর শুল্ক-অশুল্ক বাধার কারণে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের দিক দিয়ে ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের উভয় দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলে বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে কোন চুক্তি হয়নি। প্রতিরক্ষা চুক্তির বিতর্কে চাপা পড়ে গিয়েছিল বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে আলোচনার বিষয়টি। ভারত বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সেখান থেকে বাংলাদেশ ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রি বেশি আমদানি করবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাণিজ্যের আকাশ-পাতাল ব্যবধান কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং শুল্ক-অশুল্ক বাধাগুলো দূর করার বিষয়েও ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিশেষ করে সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যের ও যে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে তা প্রত্যাহারের বিষয়ে কথা বলতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশী পণ্য (মদ ও সিগারেট ছাড়া) আমদানির ক্ষেত্রে কাগজ-কলমে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। দুটি দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণও ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। তবে সীমান্ত চোরাচালানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন আরও বেশি এবং সেটাও বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। বছরে ভারত থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও রফতানি করে মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। বর্তমানে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ৪ হাজার ৭৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল ৬৮৯ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বিপরীতে ৫৪৫০ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। অর্থাৎ্ ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪৭৬১ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। যদিও এই চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বার্থপরিপন্থী। এতে ভারত একতরফা সুবিধা পেয়ে এলেও বাংলাদেশ সমবাণিজ্যে উপেক্ষিত হচ্ছে। এজন্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি অসম এবং অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ, প্যারা-ট্যারিফসহ বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক বাধা রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব বাধার অবসানে বাণিজ্য চুক্তিতে শর্ত থাকার কথা থাকলেও নবায়নকালে প্রতিবারই ভারতীয় চাপে তা উপেক্ষিত হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের অসম বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিরাজমান বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও তা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। দরকার শুধু সদিচ্ছা ও সমতাভিত্তিক বাণিজ্যনীতি। বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের ওপর অশুল্ক বাধা কমিয়ে আনার মাধ্যমে দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দরকষাকষির গুরুত্ব মোটেও কম নয়। উভয় দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশী পণ্যে বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র থাকলেও চলে না, পশ্চিমবাংলায় রফতানির ক্ষেত্রে তা দক্ষিণ ভারতের পরীক্ষাগার থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে আনতে হয়। এছাড়া কঠিন কাস্টমস বিধি, অশুল্কজনিত বাধা ও সময়ক্ষেপণ বাণিজ্যিক জটিলতা তৈরি করে। অথচ এর বিপরীতে বাংলাদেশ একতরফাভাবে ভারতীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে উদার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য সস্তায় বিক্রির সুযোগ নিশ্চিত হয়ে আছে।

বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ এখনও তেমন দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। গত বছর বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ অতিসামান্য হলেও ব্রিটেন এবং ইউরোপে ভারতের বিনিয়োগ ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে শোনা গেলেও বাস্তবে তা এখনও ঘটেনি। একইভাবে ভারতে বিনিয়োগের জন্য এফবিসিসিআই ভারতের সরকারের কাছে জমি চেয়েছে। ভারত সরকার তা দিতে রাজিও হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর এন্টি ডাম্পিং শুল্ক (বাজার দখলে কম দামে পণ্য ছাড়ার শাস্তিস্বরূপ শুল্ক) আরোপ করেছে ভারতের ডাম্পিং নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান এন্টি ডাম্পিং এন্ড এলাইড ডিউটিস (ডিজিএডি)। এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের পাটপণ্য রফতানিকারকরা। বাংলাদেশ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯১ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের পাটপণ্য ভারতে রফতানি করেছে। ভারতে বাংলাদেশের মোট রফতানির ২০ শতাংশেরও বেশি হল পাট ও পাটজাতপণ্য। এ অবস্থায় ওই শুল্ক আরোপিত হওয়ায় ভারতে বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি ডলারের পাটপণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাংলাদেশী পাটের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করলেও কোন সুফল পায়নি বাংলাদেশ।

উভয় দেশের বাণিজ্য বিষয়ে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, দু’দেশের বাণিজ্য সহজীকরণে স্থলবন্দর, রেলপথসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাণিজ্য কার্যক্রমের জন্য এক স্থানে সব সুবিধা (সিঙ্গেল উইন্ডো ফ্যাসিলিটিজ) দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে যেসব ইস্যু বাধা হিসেবে কাজ করছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুগমতার সঙ্কট। দেশের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা দরকার। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার এখনই সময়। এজন্য বাংলাদেশে আরও ভারতীয় বিনিয়োগের প্রয়োজন।

এদিকে গতকাল শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত কৃষি, হর্টিকালচার ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্পখাতের ওপর ব্যবসায়িক সম্মেলন বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ীরা অংশ নিয়েছেন। আর প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য নিয়ে বিজনেস টু বিজনেস (বি টু বি) আলোচনার ফলে দুই দেশের বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। আজ রোববার বিকাল ৪টা পর্যন্ত এই সম্মেলন চলবে।

শিল্পমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৈষম্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বরাবরই ভারতের অনুকূলে রয়েছে। ভারত ২০০১-০২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। আরো ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বাংলাদেশে আসছে বলে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা তথ্য দিয়েছেন। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত ভারতে রপ্তানি মাত্র অর্ধ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ইন্ডিয়ান চেম্বার থেকে আগত ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী বলেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। ভারতের উদ্যোক্তারা চাইলে এই ১০০টি থেকে বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল বরাদ্দ দেয়া হবে। যেখানে ভারতীয় শিল্প উদ্যোক্তারা নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারবেন।

http://www.dailysangram.com/post/290886