৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ৩:৪৪

দুঃসহ জীবন চট্টগ্রামবাসীর

জলাবদ্ধতা, ভঙ্গুর সড়ক ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসাসহ সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানসমূহের উদাসীনতা, গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতায় চট্টগ্রামে নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান সংস্থা দুই সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবে কতটা জনবান্ধব সেটা নিয়ে নগরবাসীর মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর অবকাঠামো উন্নয়নে এই দুই সংস্থা বিগত সময়ে যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে নগর পরিকল্পনাবিদরা প্রকাশ্যে সেসবের বিরোধিতা করেছেন। তারপরও নিজেদের পথেই হেঁটেছে তারা।

চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। প্রতিবার মেয়র নির্বাচনে এটি ব্যাপকভাবে প্রচারে আসে। বর্তমান মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনও প্রায় দুই বছর আগে তার ৩৬ দফার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি এ জন্য তার পূর্ববর্তী মেয়রকে ‘অথর্ব’ ও ‘অযোগ্য’ বলতেও ছাড়েননি। কিন্তু মেয়রের দায়িত্বে দুই বছর থাকার পর আ.জ.ম নাছির এখন বলছেন জলাবদ্ধতা নিরসন তার দায়িত্ব নয়। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের দিকে এই ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতা বর্তমানে ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। প্রায় ২০ বছর আগে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান করা হলেও সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাসমূহের কেউ তার যথাযথ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে নগরীতে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ও প্রত্যেকের দায়-দায়িত্বের বিষয়গুলোও উল্লেখ রয়েছে। একই সঙ্গে আবাসনসহ অবকাঠামো উন্নয়নেও ২০ বছর আগে তৈরি মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে নগরীর বিকাশ ঘটেছে। এমনকি মাস্টার প্ল্যানের বাইরে গিয়ে একাধিক ফ্লাইওভার এবং ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা অভিযোগ তুলেছেন।

নগরীর অচলাবস্থার জন্য কোন সংস্থাই দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না। যে কারণে গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছে, প্রকল্প গ্রহণের আগে বিভিন্ন সংস্থাকে যেন সিটি কর্পোরেশন থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান চালু করা হয়। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতা বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে দায়ী করে সংস্থাসমূহের দায় থেকে রেহাই পাওয়ার প্রবণতা কোনভাবেই ঠিক নয় বলে নগর পরিকল্পনাবিদদের অনেকের অভিমত।

কারণ নালা, নর্দমা, খালগুলো ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় এবং উন্মুক্ত জলাধার ভরাট করে সেখানে বাসা-বাড়ি ও অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে নগরীতে সরকারি সংস্থাসমূহ যেসব প্রকল্প হাতে নিচ্ছে তার বেশিরভাগই মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। সিডিএ কর্তৃক বেশ কটি প্রকল্পের কারণে নগরীর লালখান বাজার থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত চট্টগ্রামের মূল সড়কের ড্রেনেজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। নগরীর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকার বাসিন্দারাতো বৃষ্টির সময় ছাড়াও প্রতিদিন জোয়ার-ভাটার সময় কয়েক ঘণ্টা পানিবন্দি থাকেন। জলাবদ্ধতার সাথে সাথে নগরীর সড়ক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। খোদ সিটি কর্পোরেশনের হিসেবেই প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নগরীর কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে।

এছাড়া পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নগরবাসীর প্রাত্যহিক সেবাসমূহের অবস্থা নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা জাইকার সহায়তায় নগরীতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কর্ণফুলী শেখ হাসিনা শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু এর পুরাতন পাইপ লাইনের কারণে বিতরণ ব্যবস্থা এখনও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। কারণ ওয়াসা পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করার আগে পুরাতন পাইপ লাইন তা ধারণ করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে কোন চিন্তা করেনি। ফলে নগরীতে অসংখ্য জায়গায় সড়ক দিয়ে পাইপ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। এতে করে পানির যেমন অপচয় হচ্ছে, তেমনি সড়কগুলো পানির কারণে নষ্ট হচ্ছে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল্লাহ জানিয়েছেন, ২০২০ সাল পর্যন্ত ওয়াসা তার প্রকল্পের জন্য সড়কসমূহে কাজ করবে। তাছাড়া ওয়াসার বিতরণ লাইন এখনও নগরীর অনেক এলাকায় না থাকায় নগরবাসী নতুন প্রকল্পের পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামে বিদ্যুতের লোডশেডিং তাল মিলিয়ে চলছে। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা দিনে প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট। প্রতিদিন প্রত্যেক এলাকায় কয়েকবার থাকা না থাকার মধ্যে চললেও পিডিবি থেকে লোডশেডিং নেই বলা হয়। তারা এটাকে ফোর্সশেডিং বলে থাকে। কারণ চাহিদা অনুযায়ী সাব স্টেশনগুলো লোড নিতে পারে না। ফলে ওভারলোড কাভার করতে বিভিন্ন সময় ৩-৪টি ফিডার লাইন বন্ধ রাখতে হয়। পিডিবি যে ভাষায় চলুক না কেন কার্যক্ষেত্রে ভোক্তাগণ কিন্তু বিদ্যুৎ পায় না। তাদের গৃহস্থালির ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা হয়। একইভাবে শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

এদিকে গ্যাসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চট্টগ্রামে দৈনিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে অর্ধেকের কম। প্রতিদিন গড়ে ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়। এতে করে নগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গ্যাসের লোডশেডিংও দেখা যায়। নির্দিষ্ট সময়ে নগরীর অনেক এলাকায় গ্যাস থাকে না কিংবা খুবই কম পরিমাণ থাকে। চট্টগ্রামে অনেক শিল্প-কারখানা গ্যাসের আশায় প্রতিষ্ঠা করা হলেও গ্যাস না পাওয়ায় এক প্রকার অচলাবস্থায় পড়েছে। গত ১০-১২ বছর ধরে চট্টগ্রাম চেম্বারসহ ব্যবসায়ীরা গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি দাবি জানিয়ে আসলেও এ যাবত এর কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি।

নগর পরিকল্পনাবিদ আলী আশরাফ ইত্তেফাককে বলেন, নগরবাসীদের ভবিষ্যতে সুদিনের আশা করলে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে। মাস্টার প্ল্যানে ড্রেনেজ, ট্রাফিকসহ সব পরিকল্পনার উল্লেখ রয়েছে। নগরীতে ন্যূনতম ৩২টি সরকারি সংস্থা কাজ করে থাকে। প্রত্যেককে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের আওতায় আসতে বাধ্য করতে হবে। একই সঙ্গে এদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ না করলে শাস্তির বিধান রাখতে হবে। অর্থদণ্ড ও জেলের ব্যবস্থা করতে হবে। আলী আশরাফ বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নে দায়িত্বশীল সংস্থাসমূহ মাস্টার প্ল্যানের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারের কাছে কোন বরাদ্দ চান না। তারা বরং মাস্টার প্ল্যান বহির্ভূত কাজে বরাদ্দ নিয়ে আসেন। এতে করে নগরবাসীকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

http://www.ittefaq.com.bd/wholecountry/2017/07/08/119617