৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:৪০

যে কারণে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ

প্রায় ২ বছর ধরে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি নিম্নমুখী। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের নীতি নির্ধারকরা বেশ চিন্তিত। অবশ্য রেমিট্যান্স বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগসহ প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে কোনো খরচ লাগবে না। কিন্তু তাতেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত ৬ বছরে এটিই সর্বনিম্ন, যা উদ্বিগ্ন করছে সরকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের। এদিকে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই আশঙ্কা করছে আইএমএফ।

সূত্র জানায়, প্রবাসী আয় কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ দাঁড় করিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে ডলারের সঙ্গে বেশকিছু দেশের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জ্বালানি তেলের দরপতন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিদেশে স্থায়ী হওয়া, সৌদি আরবে আকামা (বসবাসকারী পরিচয়) সংক্রান্ত খরচ এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অপব্যবহারের কারণেই প্রবাসী আয় কমছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধিও রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়ে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

জানা গেছে, বিদেশে বৈধভাবে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছয় লক্ষাধিক। জিডিপিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশ। কিন্তু রেমিট্যান্স দিন দিন কমছেই।
ডলারের হিসাবে রেমিট্যান্স প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে অনুযায়ী, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসে- সে সব দেশের স্থানীয় মুদ্রা ডলারের তুলনায় অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে প্রবাসী আয় কমছে।
আরব দেশগুলোর অর্থনীতি জ্বালানি তেলের ব্যবসা নির্ভর। এসব দেশগুলোতে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার ধাক্কাও আছে প্রবাসী আয়ে। সেখানে জ্বালানি তেলের দাম কমায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে এসেছে। ফলে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও নতুন নিয়োগও বন্ধ রয়েছে।

এক সময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তবে এখন তাদের অনেকেই সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন। ব্যবসা করতে গিয়ে তারা সেখানে বিনিয়োগ করছেন। কোনো কোনো দেশে নিয়মের আওতায় সেদেশের নাগরিকদের ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে রাখতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে একটু ছাড় দিতেও হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীরা পরিবার নিয়ে ওই দেশগুলোতে স্থায়ী বসবাস করছেন। ফলে দেশে অর্থ পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা হারাচ্ছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশে নতুন লোক নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে সৌদি আরবে আকামার একটা সুযোগ রয়েছে। এই আকামার কাগজ বের করার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অপব্যবহারের কারণে অবৈধ পথে দেশে টাকা আসছে। বেশ কয়েকটি দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে ভুয়া এজেন্ট সেজে এদেশের এক ধরনের অসাধু এজেন্টের কাছে তথ্য দিয়ে ক্যাশ ইন করে টাকা পাঠানো হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা দেশে অর্থ পাঠালেও তা রেমিট্যান্স হিসেবে যোগ হচ্ছে না।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম রাউজান থানার বাসিন্দা ও সৌদি প্রবাসী টিপু সুলতান মানবজমিনকে ফোনে জানান, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অপব্যবহারের কারণে বৈধ পথে দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তার মতে, অফিস সময়ে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যাংকে গিয়ে দেশে টাকা পাঠানো খুবই মুশকিল। কারণ ব্যাংকে গেলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয়। আবার অফিস চলাকালীন বেশি সময় অফিসের বাইরে থাকলে চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে এক ধরনের অসাধু এজেন্টের কাছে তথ্য দিয়ে ক্যাশ ইন করে দেশে টাকা পাঠান। ফলে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা দেশে অর্থ পাঠালেও তা রেমিট্যান্স হিসেবে যোগ হচ্ছে না। এজন্য এই সিস্টেমটি বাতিল করলে দেশের বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, নতুন নিয়মে অফিসিয়ালি যে বেতনে কাজ করতে যান, তার চেয়ে বেশি টাকা পাঠাতে পারেন না কর্মীরা? ফলে নির্ধারিত কাজের বাইরে ‘অড জব’ করে তারা যে টাকা আয় করেন তা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে পারেন না। তিনি বলেন, ব্যাংকিংয়ে টাকাটা পরিবারের সদস্যদের হাতে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। সে সুযোগ বিকাশ বা অন্য কোনো ইনফর্মাল সিস্টেমে পাওয়া যায়।

এসব কারণে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অনেক কমেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে এই কমে যাওয়া রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেগুলো হলো- প্রতিটি শাখায় রেমিট্যান্স হেল্প ডেস্ক চালু করা; প্রবাস আয়ের বেনিফিসিয়ারিকে (উপকারভোগী) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেমিট্যান্স সংক্রান্ত তথ্য প্রদান নিশ্চিত করা; গ্রাহক হয়রানি রোধে প্রতিটি শাখায় প্রবাসী আয়ের বেনিফিসিয়ারিদের জন্য আলাদা খাতায় ক্রমানুসারে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা; পাক্ষিক ভিত্তিতে অভিযোগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগকে জানানো এবং প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকের নিজস্ব ও সরকারের সব ধরনের বিনিয়োগ সেবার প্রচার করা ও বৈধ পথে রেমিট্যান্স নেয়ার সুবিধা প্রচার করা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহ বলেন, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অপব্যবহার রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রোভাইডারকে দিয়ে এই বিষয়ে সতর্ক হতে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে তাদের সার্ভিলেন্স বাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা। আগের অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলার। এ হিসেবে বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৪.৪৭ শতাংশ। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৩০ লাখ (১২.৮৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর পরের চার বছরে (২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬) যথাক্রমে ১৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার, ১৪.২২ বিলিয়ন, ১৫.৩১ বিলিয়ন এবং ১৪.৯৩ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দুই বছর ধারাবাহিক রেমিট্যান্স কমে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর গত পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। গত ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার ছিল। এরপর থেকে প্রতি বছরই প্রবাসী আয় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ওপরে ছিল। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হঠাৎ প্রবাসী আয় কমে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলারে নেমে এসেছে, যা গত ৬ বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় মধ্যপ্রাচ্যে দেশগুলোতে প্রবাসীদের বেতন ও মজুরি কমে গেছে। অর্থাৎ ইনকাম কমে যাওয়া রেমিট্যান্স পাঠানো কমে গেছে। এছাড়া বড় কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো প্রক্রিয়া কঠিন হওয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=72989