৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:৩৮

চিকিৎসক সংকটের ফাঁকে দুর্ধর্ষ বন্দীরা হাসপাতালে

৬৮ হাজার বন্দীর জন্য চিকিৎসক ৫ জন

দেশে মোট কারাগার রয়েছে ৬৮টি। বর্তমানে বন্দীর সংখ্যা ৬৮ হাজার। তাঁদের জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র পাঁচজন। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে কেবল ১৪টি কারা হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।
কারা অধিদপ্তর বলছে, এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা-সংকটের সুযোগ নিয়ে মাঝেমধ্যেই দুর্ধর্ষ ও ভিআইপি বন্দীরা বিভিন্ন রোগের অজুহাত দেখিয়ে মাসের পর মাস কারাগারের বাইরের হাসপাতালে থাকছেন। এই মুহূর্তে সারা দেশে এমন প্রায় ১০০ জন বন্দী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আছেন।

যদিও কারা অধিদপ্তরের এই যুক্তি পুরোপুরি ঠিক বলে মনে করেন না পর্যবেক্ষকেরা। তাঁরা বলছেন, দুর্ধর্ষ ও ভিআইপি বন্দীদের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার পেছনে একশ্রেণির কারা কর্মকর্তার হাতও রয়েছে। চিকিৎসা-সংকটকে তাঁরা এ ক্ষেত্রে অজুহাত হিসেবে হাজির করছেন। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বন্দী ফেরত নেওয়ার বিষয়ে বললেও কারা কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

চিকিৎসা-সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হলেন সাধারণ ও গরিব বন্দীরা। অন্যদিকে আর্থিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন বন্দীরাই মূলত বাইরের হাসপাতালে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে থাকেন।
খুনের মামলার আসামি টাঙ্গাইলের সরকারদলীয় সাংসদ আমানুর রহমান, শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ, মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আমিন হুদা, দুর্নীতি মামলার আসামি বেসিক ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন চৌধুরীসহ কয়েকজন বন্দীর গুরুতর রোগ না থাকলেও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলেন। এ নিয়ে গত মে মাসে প্রথম আলোয় একাধিক খবর ছাপা হয়। এরপরই তাঁদের হাসপাতাল থেকে কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়। যদিও আমিন হুদা কারাগারে ফিরে যাওয়ার দেড় মাসের মাথায় গত ২২ জুন রাতে আবার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
কারাগার পরিদর্শক কমিটির সাবেক সদস্য ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের পরিচালক গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, দেখা যাচ্ছে, গরিব বন্দী জেলখানায় পড়ে থাকে। টাকা পয়সা যাদের আছে তারা সুখ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। তিনি কারা পরিদর্শকদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকার পাশাপাশি পুরো ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, সরকারের সঙ্গে যারা কোনোভাবে যুক্ত নয় এমন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মূলত কারা পরিদর্শক হতে পারবেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সরকার দলীয় লোকজনকে পরিদর্শক হিসেবে নেওয়ায় পুরো ব্যবস্থাটিই নষ্ট হয়ে গেছে।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বর্তমানে মোট কারাগার রয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে ৬৪ জেলায় ৬৪টি এবং কাশিমপুরে অতিরিক্ত ৪টি কারাগার আছে। এসব কারাগারে মোট বন্দী রয়েছে ৬৮ হাজার।

কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ হাজার ৮০৩ জন বন্দীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নেই। সেখানে চিকিৎসক আছেন মাত্র দুজন। এ ছাড়া বাকি ৬৭ কারাগারে হাসপাতাল আছে ১টি করে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় ১টি কারাগারে একজন করে চিকিৎসক আছেন। বাকি ৬৪ কারা হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক নেই। এর বাইরে ৬৮ কারাগারে নার্স আছেন ১০৬ জন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ১৪টি কারাগারে বন্দী রোগী বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স আছে ১৫টি। বাকি ৫৪টি কারাগারে অ্যাম্বুলেন্স নেই।

কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন প্রথমআলোকে বলেন, চিকিৎসক, নার্স-সংকটের কারণে কারা হাসপাতালগুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বন্দীরা বিভিন্ন রোগের কথা বলে কারাগারের বাইরের হাসপাতালে থাকার সুযোগ নিচ্ছেন। ৬৮ কারাগারে ১২ মনোবিজ্ঞানীসহ ১২৯ চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক আছেন মাত্র পাঁচজন। কারা হাসপাতালগুলোতে ওষুধ ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি থাকলেও চিকিৎসক, নার্স-সংকটের কারণে বন্দীদের মৌলিক যে স্বাস্থ্যসেবা, তা দেওয়া যাচ্ছে না।
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৫০ শয্যার হাসপাতালপ্রকল্প প্রণয়নের কাজ চলছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে হাসপাতালটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা যাবে বলে মনে করে কর্তৃপক্ষ।

কারা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বিভিন্ন কারাগারের বন্দীরা কিডনি, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ু, গ্যাস্ট্রিক, মানসিকসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এই বন্দীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার ১৪টি বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হয়। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্স। একই সময় একাধিক বন্দীকে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর দরকার হলে তখন কর্তৃপক্ষ হিমশিম খায়। আবার যেসব কারা হাসপাতালে চিকিৎসক নেই, সেখানের বন্দীরা অসুস্থ হওয়ার কথা বললেও তাঁদের রোগ সম্পর্কে জানা যায় না এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসাও দেওয়া যায় না। তাঁদের কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকায় পাঠানোর পথেই মারা যান।
এসব জানতে চাইলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কারা হাসপাতালগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অধিকাংশ কারাগারে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নেই। জেলা কারাগারগুলোতে সপ্তাহে বা দিনের যেকোনো একটা সময় চিকিৎসক নিয়ে আসা হয় বন্দীদের জন্য, তা-ও অত্যন্ত অপ্রতুল। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, কারাগারের কিছু অসাধু লোকের সহায়তায় সেখানের চিকিৎসকের পরামর্শে ভিআইপি বন্দীরা ঢাকার বড় হাসপাতালে আরাম-আয়েশে দিন জীবন যাপন করছেন। এ ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ওপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1242446