৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:৩৪

ড. আলী রিয়াজের প্রশ্ন- রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ‘অনুমোদনের’ গল্প কোথায়?

একটি বিশেষ খবর নিয়ে গত বৃহস্পতিবার দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে এক ধরনের তুলকালামকাণ্ড ঘটে গেছে। যে যেভাবে পারছে খবরটি দ্রুত প্রকাশ করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছে। আরটিএনএন।
প্রায় সবকটি জাতীয় দৈনিক, অনলাইন পত্রিকা ও টেলিভিশন খবর প্রকাশ করেছে যে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে আপত্তি তুলে নিয়েছে ইউনেস্কো। সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসও একই ধরনের খবর দিয়েছে। বাসসের সংবাদের শিরোনাম- ‘রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে আপত্তি তুলে নিল ইউনেস্কো’। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো খবর প্রকাশ করেছে ‘রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্প নিয়ে ইউনেস্কোর আপত্তি প্রত্যাহার, দাবি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের’। বিশ্বে বহুল জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম বিবিসিও একই ধরনের খবর প্রকাশ করে। তাদের সংবাদের শিরোনাম ছিল- ‘রামপাল প্রকল্প নিয়ে আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইউনেস্কো : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’।

গণমাধ্যমগুলোর ভিন্ন ভিন্ন শিরোনাম হলেও সংবাদের বিষয়বস্তু ও তথ্য প্রায় একই ধরনের ছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ দিয়ে গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ইউনেস্কোর ওযয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির যে আপত্তি ছিল তা তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পোলান্ডের ক্র্যাকো শহরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশনে ইউনেস্কো তাদের আপত্তি প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত নেয়।
কমিটির ওই অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি দল উপস্থিত ছিল।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনেক বিচার বিবেচনা করে কমিটি রামপাল প্রকল্প নিয়ে তাদের আপত্তি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু তারা এটাও বলে যে সুন্দরবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নিতে হবে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তুতি হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেসব উদ্যোগকে স্বাগতও জানিয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি।

সুন্দরবনের ঐতিহ্য রক্ষায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে আশ্বস্তও করা হয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ইউনেস্কোর রিপোর্টে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতির আশংকার কথা বলা হয়েছিল?
রামপাল প্রকল্প নিয়ে ত্রিশ পৃষ্ঠার বেশি দীর্ঘ এই রিপোর্টটি ইউনেস্কো প্রকাশ করে গত বছরের অক্টোবর মাসে। তাতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মূলত চার ধরনের ক্ষতির আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে কয়লা পুডেিয়। এই কয়লা পোড়ানোর পর সেখান থেকে নির্গত কয়লার ছাইকে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ইউনেস্কোর ওই প্রতিবেদনে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য এবং পানিকে দ্বিতীয় হুমকি হিসেবে গণ্য করে ইউনেস্কো।
এই প্রকল্পকে ঘিরে সুন্দরবন এলাকায় যেভাবে জাহাজ চলাচল বাড়বে এবং ড্রেজিং করার দরকার হবে, সেটিও সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

আর সবশেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে ওই অঞ্চলের সার্বিক শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডও সুন্দরবনের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করে ইউনেস্কো।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল কনজার্ভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) এর তিনজন বিশেষজ্ঞ সরেজমিনে ঘুরে দেখে এবং বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ওই রিপোর্টটি তৈরি করেন।
রিপোর্টে বলা হয়, যেখানে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে, সেটি সুন্দরবনের সীমানা থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্টের (ইআইএ) জন্য আইউসিএন যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা ঠিকমত মেনে চলা হয়নি বলে উল্লেখও করা হয় ওই রিপোর্টে।

এছাড়া সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতি এড়াতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ধরনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং যেরকম আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে চলা উচিত, সেটাও করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করা হয় ইউনেস্কোর রিপোর্টে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে গণমাধ্যমে খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হৈ চৈ হয়। বিশেষ করে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সমর্থকরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অন্যদিকে এর বিরোধিরা অনেকটাই হতবাক হন। তারা ইউনেস্কোর সমালোচনা করেও বক্তব্য-বিবৃতি ও স্ট্যাটাস দেন।

এনিয়ে দেশে ও প্রবাসীদের মধ্যে চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। এরই মধ্যে একদিন পরেই গতকাল শুক্রবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ইউনেস্কোর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে তারা কিছু শর্ত দিয়েছে।

গতকাল শুক্রবার প্রতিমন্ত্রী গুলশানে তার নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে একথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী এও জানান, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে শর্তগুলো মানা হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেছি।
নসরুল হামিদ আরও বলেন, গত বুধবার পোল্যান্ডের ক্রাকাও শহরে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৪১তম সভায় বাংলাদেশের সুন্দরবনের বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। সেখানে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। ওই প্রতিনিধিদলটি এই কেন্দ্রের কারণে পরিবেশে যেসব প্রভাব পড়বে সেগুলোও তুলে ধরেছেন।
তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন পরিবেশ সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে সুন্দরবনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না।
নসরুল হামিদ আরও জানান, ইউনেসকো যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে তার প্রতিটি উত্তর যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ তুলে ধরেছে।
গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
২ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম বার্ষিক অধিবেশনে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

তবে ইউনেসকো ও বিশ্ব ঐতিহ্যবিষয়ক কমিটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা হয়নি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে সুন্দরবনের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ গেল কি গেল না, সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির খসড়া সিদ্ধান্ত অনুসারে, সুন্দরবন ও তার আশপাশের এলাকা (দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল) নিয়ে একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদন করতে হবে। ওই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে রামপালসহ ওই এলাকায় কোনো ধরনের শিল্পকারখানা না করার পক্ষে ইউনেসকো থেকে বলা হয়েছিল।
খসড়া সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদ খননের আগে অবশ্যই পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে। সুন্দরবনের প্রতিবেশগত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন (ইকোলজিক্যাল মনিটরিং রিপোর্ট) দিতে হবে। এই সুপারিশগুলো বাংলাদেশ কতটা বাস্তবায়ন করল, সে ব্যাপারে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশকে প্রতিবেদন দিতে হবে।
সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান যেন বজায় থাকে, সে জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের উদ্যোগ নেবে।

ওই দলে ছিলেন বিদ্যুৎসচিব আহমদ কায়কাউস, ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেসকোর স্থায়ী প্রতিনিধি এম শহিদুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউর রহমান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছুল আলম ম-ল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হুসাইন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুলতান আহমেদ।
এদিকে দেশে-বিদেশে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেইে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইউনেস্কোর ভাষ্য নিয়ে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি রামপাল প্রকল্প নিয়ে ইউনেস্কো কী বলেছে তাদের একটি রিপোর্টের লিংকও তুলেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘প্রসঙ্গ রামপাল প্রকল্প এবং ইউনেস্কো- ধৈর্য্য ধরে চার পৃষ্ঠা পড়ুন ; ৫৫ থেকে ৫৮, তাহলেই বুঝতে পারবেন ইউনেস্কো কী বলেছে; ‘অনুমোদনের’ গল্প কোথায়?’

http://www.dailysangram.com/post/290737