৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:৩৩

নিবন্ধিত সাড়ে ৬ হাজার ‘শিল্প বয়লার’ তদারকি করছেন ৭ জন পরিদর্শক

নিয়মিত তদারকি হয়না শিল্পখাতে ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বয়লার। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। সর্বশেষ কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় মাল্টিফ্যাবস পোশাক কারখানায় গত সোমবার সন্ধ্যায় বয়লার বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় ১৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনজন নিখোঁজ আছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এর আগে গতবছর টঙ্গি শিল্প নগরীর একটি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ২৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়লার বিস্ফোরণে মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনবলের অভাবে শিল্পখাতের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বয়লার এর কার্যকর কোন তদারকি হয় না। মাত্র ৭ জন পরিদর্শক সাড়ে ৬ হাজার বয়লার তদারকির দায়িত্ব রয়েছেন। আগে ৫জন পরিদর্শক দায়িত্বপালন করলেও কাশিপুরের দুর্ঘটনার পর গত ৩ জুলাই আরো ২ জন পরিদর্শক নিয়োগ পায় এছাড়া ১৯২৩ সালের পুরোনো আইনেই চলছে বয়লার নিবন্ধনসহ পরিদর্শনের দায়িত্ব। যদিও ১৯৯০ সালে ঐ আইনের কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। বিপজ্জনকভাবে ব্যবহারের কারণে প্রায়ই বয়লার দুর্ঘটনা ঘটলেও পরিদর্শনের মান উন্নত হচ্ছে না।
প্রধান বয়লার পরিদর্শক কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে নিবন্ধিত বয়লার সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার। তবে নিবন্ধন ছাড়া এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। বয়লার পরিদর্শনের রয়েছেন পরিদর্শক ৭ জন।

সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় বয়লারের চাহিদা মেটানো হতো আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আমদানির মাধ্যমে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বয়লার রেগুলেশন (বিবিআর) প্রণয়নের পর থেকে দেশেই তৈরি হচ্ছে যন্ত্রটি। বর্তমানে শিল্প-কারখানায় সচল বয়লারের প্রায় ৫০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে তৈরি। নির্মাণকাল থেকেই এসব বয়লারের মান তদারকির দায়িত্ব প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের। কিন্তু জনবল ঘাটতিতে কাজটি করতে পারছে না তারা।
প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের পরিদর্শক প্রকৌশলী মো. শরাফত আলী বলেন, নিরাপদ বয়লার ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমাদের দপ্তরে জনবলের ঘাটতি আছে। জনবল ঘাটতি বয়লারের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তবে জনবল বাড়ানোর মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রক্রিয়াটি চলমান। আশা করছি, শিগগিরই এর একটি সমাধান হবে। বয়লার পরিচালনায় দক্ষতার ঘাটতিও প্রকট।

পরিদর্শকের কার্যালয় বলছে, একটি বয়লার ১০০ বছর পর্যন্তও চলতে পারে। এজন্য প্রয়োজন হয় এগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার। দক্ষ পরিচালক ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণও সম্ভব হয় না। বয়লার বিস্ফোরণের বেশির ভাগ ঘটনাও ঘটে পরিচালন দক্ষতার অভাবে। এর মধ্যে রয়েছে নকশাকালীন নির্ধারিত চাপের চেয়ে বেশি চাপে বয়লার পরিচালনা, বয়লারে পানির সঠিক পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ না করা ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও তা ব্যবহার করা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সোমবার গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডে বিস্ফোরিত বয়লারটিও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। জার্মানির অমনিকল ব্র্যান্ডের বয়লারটির মেয়াদ গত ২৪ জুন শেষ হয়। মেয়াদোত্তীর্ণের আটদিন পরও বয়লারটি সচল করার চেষ্টা করছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ। সচল করার চেষ্টার শুরুতেই কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অপারেটরদের। প্রেসার লিমিট সুইচ বা যে চাবির মাধ্যমে চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তা উপেক্ষা করেই বয়লার সচল করার চেষ্টার এক পর্যায়ে এটি বিস্ফোরিত হয় এবং ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।

প্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশে যত বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, তার অন্যতম কারণ নির্ধারিতের বেশি চাপে বয়লার পরিচালনা। ধারণা করছি, গত সোমবারের বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনাটিও একই ভুলের কারণে। এছাড়া আমাদের দেশে বয়লার পরিচালনার কারিগরি দক্ষতারও ঘাটতি আছে। দক্ষ অপারেটর থাকলেও সামান্য অসচেতনতায় বয়লার বিস্ফোরণ হতে পারে।

শুধু গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস নয়, গত এপ্রিলে দিনাজপুরের একটি চালকলে বয়লার বিস্ফোরণে ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বয়লার বিস্ফোরণ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে আছে রংপুরের ডায়মন্ড পার্টিকেল বোর্ড, এসভি টোব্যাকো কোং, মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, ফাহাদ অটো রাইস মিল, ইফাদ অটো রাইস মিল, আল-জয়নাল গার্মেন্টস অ্যান্ড হোসিয়ারি, গাউসিয়া অটো রাইস মিলস ও শাওবান ফিশিং নেট লিমিটেড।
জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ৩৯টি বয়লার পরিদর্শন এবং চালানোর অনুমতি দেয় প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়। নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয় ৬৯৭টি, স্থায়ীভাবে তৈরি বয়লার পরিদর্শন করে সদন দেয় ৩২৩টিকে এবং বয়লার পরিদর্শকগণ ১০৪১টি পরীক্ষা গ্রহণ করে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪৫০ বয়লার পরিদর্শন করে চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ৪১৫টি। স্থানীয় ভাবে তৈরী বয়লার পরিদর্শন শেষে সনদ দেয়া হয় ১৮১টি। বয়লার পরিচালকেদের সদন দেয়া হয় ১২৩৩জনকে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৯৫৪টি বয়লার পরিদর্শন করে চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ৩৩৭টি। স্থানীয় ভাবে তৈরী বয়লার পরিদর্শন শেষে সনদ দেয়া হয় ১১৬টি। চালক সনদ দেয়া হয় ৪০৯জনকে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৬৬৮টি বয়লার পরিদর্শন করে চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ৩২৮টি। স্থানীয় ভাবে তৈরী বয়লার পরিদর্শন শেষে সনদ দেয়া হয় ১২৪টি। চালক সনদ দেয়া হয় ৮৩৪ জনকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৯০০টি বয়লার পরিদর্শন করে চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ৩৪৩টি। স্থানীয় ভাবে তৈরী বয়লার পরিদর্শন শেষে সনদ দেয়া হয় ১১১টি। চালক সনদ দেয়া হয় ৭৭৬ জনকে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪০১১টি বয়লার পরিদর্শন করে চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ৩০৯টি। স্থানীয় ভাবে তৈরী বয়লার পরিদর্শন শেষে সনদ দেয়া হয় ১০৩টি। চালক সনদ দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। বেসরকারি সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) সম্প্রতি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছে, দেশে বয়লার তৈরির কারখানা রয়েছে ২০০টি। অনেকে উৎপাদন চালু রাখতে পারছে না। কারণ, বয়লারের নিবন্ধন ও নবায়নের প্রক্রিয়া জটিল। অনেকেটিকতে না পেরে বন্ধ করে দিচ্ছেন কারখানা। কেউ কেউ অবৈধভাবেও বয়লার তৈরি করছেন। সূত্র জানায়, সর্বপ্রথম ১৯২৩ সালে বয়লার আইন সমগ্র ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৪ সালে কলকাতায় বয়লার অধিদপ্তর স্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বয়লার অধিদপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। অতঃপর ১৯৬১ সালে বয়লার অধিদপ্তর শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ শুরু করে। বর্তমান সময় পর্যন্ত বয়লার অধিদপ্তর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, কল-কারখানার সার্বিক নিরাপত্তা নিয়মিতভাবে পরিদর্শন করা হয় আমাদের সংস্থা থেকে। গত দুই বছরে আমাদের সক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। দুর্ঘটনাও অনেক কমে এসেছে। তার পরও দুর্ঘটনা ঘটছে। গত সোমবারের ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটিতে ডিআইএফইর প্রতিনিধিও রয়েছেন। তবে তদন্ত চলমান থাকায় মাল্টিফ্যাবসের দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না।

http://www.dailysangram.com/post/290735