৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:২৮

সিলেটে ৫০ পয়েন্টে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে

 পানি কমতে শুরু করলেও সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর অর্ধশতাধিক পয়েন্টে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নিয়ে শঙ্কা কাটছে না। ঝুঁকির মুখে রয়েছে এসব এলাকার বাঁধ। বাঁধ ভেঙে গেলে তলিয়ে যাবে সিলেট জেলার বাকি এলাকাও। নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়বে আরো প্রায় ৫টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তত ১০টি এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে বালুর বস্তা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর দুই তীরেই রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। উজানের ঢলে যাতে আকস্মিক লোকালয় তলিয়ে না যায় সে কারণে অনেক আগেই এসব বাঁধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড বছর বছর এসব বাঁধ মেরামতের কথা থাকলেও টাকা না পাওয়ায় তারা বাঁধ মেরামতের কাজ করতে পারেনি। গত অর্থবছরেও বাঁধে নামমাত্র কাজ হয়েছে। এ কারণে এবারের ঢলে কুশিয়ারা নদীর ৬ উপজেলা বাঁধ ভেঙেই তলিয়ে গেছে। সিলেটের কানাইঘাটে সুরমা নদীর বাঁধ অন্তত ৫টি স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। খোদ পৌরসভাও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, বাঁধ রক্ষা করতে প্রাথমিক কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরপরও ঝুঁকিমুক্ত হচ্ছে না। গেল ১৫ দিন ধরে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি। সবকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৫০ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। লোকালয়ও একাকার। বাতাসে হাওর ও নদীর পানি ঢেউ খেলছে। আর প্রবল বেগে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। এজন্য কানাইঘাটে সুরমা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থল জকিগঞ্জে এবারের বন্যায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মাত্র একটি ইউনিয়ন পানিতে ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু ওই উপজেলায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর কমপক্ষে ২৫টি পয়েন্টে হুমকির মুখে রয়েছে। এজন্য নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। স্থানীয় হিসাব মতে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ৫৭ পয়েন্টে বাঁধ হুমকির মুখে। এর মধ্য কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী সুলতানপুর ইউনিয়নের শহীদাবাদ গ্রামের জামে মসজিদ ও আশপাশ এলাকার বাঁধ নড়েবড়ে। বীরশ্রী ইউনিয়নের বরছালিয়া গ্রাম, উজিরপুর, লাফা কানো গ্রাম, খলাছড়া ইউনিয়নের ভুইয়ারমোড়া, লোহারমহল পয়েন্টে বাঁধ হুমকিতে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে এসব এলাকায় বালুর বস্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঢেউয়ের তোড়ে বাঁধের ভেতরে থাকা বাড়িঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে। জকিগঞ্জ পৌরসভার কুশিয়ারাঘাট এলাকার বাঁধ নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বন্যার শুরুতেই হুমকির মুখে পড়েছিল। পড়ে পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলররা নিজ উদ্যোগে বালুর বস্তা দিয়েছে বাঁধ রক্ষা করেছেন। এছাড়া, পৌরসভার হাইদ্রাবন্দ এলাকায় ফাটল দেখা দিয়েছে বাঁধে। জকিগঞ্জ ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সুরমা নদীর তীরবর্তী দুটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টেও বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। ঢেউ বেশি থাকায় এসব এলাকায় বাঁধ যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়নের শীর্ষ কর্মকর্তারা চলতি সপ্তাহে এলাকা পরিদর্শন করে বাঁধ রক্ষায় কাজ শুরু করেছেন। বারঠাকুরী ইউনিয়নের উত্তরকুল ও মীনাপাড়া গ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে বলে জানান স্থানীয়রা। বারহাল ইউনিয়নের উত্তর কিলোগ্রাম, নোয়াগ্রাম ও মুহিতপুরেও সুরমা ডাইকে পানি বাড়ায় আতঙ্ক বাড়ছে। পানি চাপ কমাতে গত বুধবার স্থানীয়রা জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর রাধার খালের মুখ কেটে দিয়েছিলেন। এতে হু-হু করে পানি ঢুকে কাজী আব্দুল খালিক উচ্চ বিদ্যালয়সহ পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। খবর পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে পুনরায় বাঁধ দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাঁধ ভেঙে বন্যায় ভেসে গেছে সিলেটের বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ। উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নে কোনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। এ কারণে রমজানের শেষ দিকেই তলিয়ে যায় ওই ইউনিয়নের গজুকাটা, বড়গ্রাম, নয়া দুবাহ, চড়িয়া, পান্দিপুরীসহ কয়েকটি এলাকা। আর ওই সব পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে বিয়ানীবাজারের ৮টি ইউনিয়ন তলিয়ে যায়। এখন অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে শ্যাওলা ইউনিয়নের কাকরদী গ্রাম ও কুড়ারবাজারের কয়েকটি গ্রাম। বাঁধ ভেঙে গেলে সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের কয়েক কিলোমিটার এলাকার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এমন ঘটনা ২০০৪ সালে ঘটেছিল বলে দাবি করেন তারা। বালাগঞ্জের কয়েকটি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রমজানের শেষ দিকে করচারপাড়, রাধাকোনাসহ কয়েকটি এলাকার বাঁধ ভেঙে যায়। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। হুমকির মুখে রয়েছে কুশিয়ারা নদীর পূর্ব পৈলনপুর ইউনিয়নের বঙ্গপুর এলাকার বাঁধ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- বালাগঞ্জ উপজেলা সদর পুরোটাই কুশিয়ারা নদীর তীরে। প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা বাঁধ থাকায় বন্যা হলেই পানিতে তলিয়ে যায় বালাগঞ্জ উপজেলা সদর। ওসমানীনগরে কুশিয়ারা তীরবর্তী প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে। এখন পানি বাড়ছে না। কিন্তু বন্যা স্থায়ী রূপ নেয়ায় ঢেউয়ের তালে ওসমানীনগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। ঈদের পরপরই ভেঙে যায় লামাতাজপুর এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। প্রায় ৪০ ফুট এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে এক রাতেই অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবিন্দ হয়ে পড়েন। ইব্রাহিমপুর, খসরুপুরসহ কয়েকটি এলাকার কুশিয়ারার ডাইক হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয়রা জানান। ফেঞ্চুগঞ্জের বুড়িকিয়ারী বাঁধ হুমকির মুখে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধ রক্ষায় বালুর বস্তা দিয়েছেন। হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী হওয়ার কারণে এই বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী বাঁধগুলো হুমকির মুখে রয়েছে। যতটুকু সম্ভব ওই বাঁধগুলো রক্ষার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন- বন্যা উপদ্রুত এলাকায় পানি একটু একটু করে কমছে। এতে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য ঢেউয়ের কারণে এসব বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দিন-রাত পরিশ্রম করে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=73014&cat=2