৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:২১

বদলির নতুন নিয়মে বেড়েছে শিক্ষক হয়রানি ও দুর্নীতি

সরকারি প্রাইমারি স্কুল

সরকারি প্রাইমারি স্কুলে বদলির ক্ষেত্রে শিক্ষকদের হয়রানি আর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের (টিও) দুর্নীতি বন্ধে ২০১৫ সালে বদলির নতুন নীতিমালা জারি করা হয়। কিন্তু নতুন জারি করা নিয়মের ফলে শিক্ষকদের ভোগান্তি ও টিওদের দুর্নীতি আগের চেয়ে গত দুই বছরে অনেক বেড়েছে। শিক্ষকরা জানিয়েছেন আগে যেখানে বদলির ক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হতো, এখন সেখানে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। শিক্ষকদের বদলি উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির ওপর ন্যস্ত করায় এখন উপজেলা চেয়ারম্যানকেও ম্যানেজের কাজ করতে হয়। এতে বাড়ছে রাজনৈতিক হয়রানি। অর্থের পাশাপাশি দলীয় আনুগত্য প্রকাশ ছাড়া বদলি হওয়া অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছে শিক্ষকদের। অনেকে শিকার হচ্ছেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার।

আগে উপজেলার মধ্যে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকদের বদলির একক ক্ষমতা ভোগ করতেন টিও। বদলিসহ নানা ক্ষেত্রে শিক্ষকরা অসহায় পড়েছিলেন টিওদের কাছে। টিওদের দুর্নীতি ও হয়রানি বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরে খবর প্রকাশিত হতে থাকলে সরকার ২০১৫ সালে বদলির নতুন নীতিমালা জারি করে। উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠন করে তাদের ওপর বদলির দায়িত্ব দেয়া হয়। এ কমিটির সদস্য সচিব রাখা হয় টিওকে।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন মূলত এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বদলির ক্ষমতা আগের মতো টিওরাই ভোগ করছেন। তিনি যে তালিকা তৈরি করেন ওই অনুযায়ীই বদলি করা হয়। সব ক্ষেত্রে কমিটি এসব দেখভাল করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যান একক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন কমিটির ওপর। তবে শিক্ষকরা জানিয়েছেন আগে বদলির জন্য শুধু টিওকে ম্যানেজ করতে হতো। এখনো টিওকেই মূলত ম্যানেজ করতে হয়। কিন্তু টাকা অনেক বেশি লাগে। কারণ অনেক টিও কমিটির চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সদস্যকে ম্যানেজ করার কথা বলে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন। আগে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিলেই হয়ে যেত। তা ছাড়া আগে শুধু টিওর হাতে বদলির ক্ষমতা থাকায় দ্রুত বদলির কাজ হয়ে যেত। কিন্তু এখন অনেক বেশি সময় লাগে।

কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার এক শিক্ষিকা জানান, টিও বলেন কমিটির অনেককে টাকা দিতে হয়। শেষে আমাদের ভাগে আর কয় টাকা থাকে। তা ছাড়া আপনাদের বেতন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। টাকা বেশি দেবেন না কেন?
ঢাকার বাইরের একজন টিও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বদলির বিষয়টি এখন পুরো রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আগে শিক্ষকদের যোগাযোগ থাকত টিও অফিসে। এখন তাদের যোগাযোগ করতে হয় উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথেও। আর বদলির ক্ষেত্রে টিও যাতে আগের মতো ভূমিকা রাখতে না পারেন সে জন্য অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং করেন। শিক্ষকদের হাতে রাখেন। বদলির টাকা যাতে সরাসরি তার কাছে পৌঁছে সে জন্য নিজস্ব লোক ঠিক করে রাখেন। ুব্ধ এ শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, আগে যেখানে আবেদনের সাথে সাথে একজন শিক্ষককে বদলি করা যেত এখন সেখানে পুরো কমিটির সম্মতি আদায় করতে দু-তিন মাস পর্যন্ত লেগে যায়। তিনি বলেন, অনেক টিও বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতির সাথে জড়িত এটি সত্য কিন্তু তারা আগে খুব অল্প টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের বদলির কাজটি করে দিত। এখন অনেক বেশি টাকা নিচ্ছে অনেক টিও। অনেক ক্ষেত্রে কমিটিকে ম্যানেজ করার কথা বলে অনেক বেশি টাকা আদায় করে। আসলে তারা কমিটিকে টাকা দেন না। বদলির নতুন নিয়মে শিক্ষকরা এখন রাজনীতি আর দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তার মতে বদলির আগের নিয়মই ভালো ছিল।

কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার টিও আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বদলি বাবদ ৪০ হাজার করে টাকা আদায়সহ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার বেপরোয়া দুর্নীতি ও শিক্ষকদের হয়রানির কারণে স্থানীয় এমপি মেজর জেনারেল (অব:) সুবেদ আলী ভুইয়ার ডিও লেটারের কারণে তাকে বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে।
একজন শিক্ষিকা জানান, গত মার্চে তিনি এটিও হরিদাশ শংকরের কাছে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন বদলির জন্য। তার সাথে আরো দু’জন শিক্ষিকা প্রত্যেকে ৪০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাউকেই এখন পর্যন্ত বদলি করা হয়নি। টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। টাকা চাইলে বলে খরচ হয়ে গেছে। আগামী বছর হয়তো বদলি করবে এ জন্য টাকা ফেরত দিচ্ছেন না।
মেঘনা উপজেলার কয়েক শিক্ষক-শিক্ষিকা জানান, গত এক বছর তিন মাসে টিও আরিফুল হক কমপক্ষে আট শিক্ষককে বদলি করেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি সংযুক্তি বদলির কাজও করেছেন কয়েকজনকে। নীতিমালা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ছাড়া অপর কেউ সংযুক্তি বদলি করতে পারে না। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে টাকার বিনিময়ে তিনি ডিপিইনএড প্রশিক্ষণে পাঠান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় একজন শিক্ষকের বেতন তিন মাস ধরে বন্ধ করে রেখেছেন টিও। জেলা শিক্ষা অফিস থেকে টিওকে শিক্ষকের বেতন দেয়ার নির্দেশে দেয়ার পরও তিনি তা পালন করেননি। এ জন্য তাকে শোকজও করা হয়েছে। জলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাশিদা আক্তার তিন বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে এক দিন মাসিক মিটিংয়ে তার স্থানে জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন সহকারী শিক্ষককে সংযুক্তি বদলির আদেশ দেন টিও। রাশিদা আক্তার ১৫-১৬ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। আর জাহাঙ্গীর আলম মাত্র ২-৩ বছর ধরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। টিওর এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব শিক্ষক প্রতিবাদ জানান। কিন্তু যে শিক্ষক সর্বপ্রথম দাঁড়িয়ে মিটিংয়ে এর প্রতিবাদ জানান টিও তার বেতন বন্ধ করে দেন। গত এপ্রিল মাস থেকে এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে ওই শিক্ষকের বেতন।

শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানিয়েছেন টিওর হয়রানির শেষ নেই। টাকা ছাড়া টিও অফিসে কোনো কাজ হয় না। সম্প্রতি দু’জন শিক্ষক শ্রান্তি বিনোদনের ছুটি নিতেও টাকা দিতে হয়েছে টিও অফিসে। সপ্তাহে দুই দিনের বেশি তিনি অফিস করেন না। শিক্ষকরা অফিসে গিয়ে বেকার ঘুরে আসেন অনেক সময়। টিও আরিফুলের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ব্যাপক অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের উদ্যোগে ২৯ জুন তাকে বদলির আদেশ দেয়া হয়। আগামী রোববারের মধ্যে তাকে ফুলগাজী উপজেলায় যোগ দিতে বলা হয়েছে। টিও বদলির আদেশ ঠেকাতে তদবির করছেন বলে জানান শিক্ষকরা। টিও আরিফুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেশ কয়েকবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও কোনোবারই রিসিভ করেননি তিনি।

২০১৫ সালের ৫ জুলাই সর্বশেষ জারি করা নীতিমালার আগে শিক্ষকদের বদলির ক্ষমতা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে ন্যস্ত ছিল। উপজেলার মধ্যে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে এবং এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় শিক্ষকদের বদলির প্রস্তাব উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পাঠিয়ে থাকেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ প্রস্তাব অনুমোদন করলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বদলির আদেশ জারি করেন। বলতে গেলে এসব বদলির ক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একক ক্ষমতা ভোগ করতেন। তবে ২০১৫ সারের জারি করা নীতিমালায় বদলির ক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার একক ক্ষমতা রহিত করা হয়েছে। নতুন ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী হয়েছে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নন বরং বদলির সুপারিশ বা প্রস্তাব তৈরি করবে উপজেলা শিক্ষা কমিটি। শিক্ষা কমিটির সুপারিশক্রমে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তার অধীনস্থ উপজেলা বা থানা ও জেলার মধ্যকার বদলির অনুমোদন করবে। আন্তঃজেলা বদলি অনুমোদন করবেন বিভাগীয় উপপরিচালক।

নতুন জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য ১৬ জন। প্রধান উপদেষ্টা স্থানীয় সংসদ সদস্য। উপজেলা চেয়ারম্যান কমিটির সভাপতি। সদস্য সচিব উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, একজন পুরুষ বিদ্যোৎসাহী সদস্য, একজন মহিলা বিদ্যোৎসাহী সদস্য, উচ্চবিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা, একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের একজন সদস্য, প্রাইমারি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির একজন সভাপতি, উপজেলা মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা প্রমুখ শিক্ষা কমিটির সদস্য হবেন।

নতুন জারি করা বদলি নীতিমালায় মন্ত্রণালয় যেকোনো সময় যেকোনো শিক্ষককে যেকোনো স্কুলে সংযুক্তি বদলি করতে পারবে বলে বলা হয়েছে। এ সংযুক্তি বদলি মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ করতে পারবে না।
বদলির এ নতুন নীতিমালা জারির সময়ই শিক্ষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এতে তাদের হয়রানি আরো বাড়বে। গত দুই বছেরর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে অনেক শিক্ষক বলেছেন বাস্তবে তাই সত্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরা জানান, বদলির ক্ষেত্রে জেলা শিক্ষা অফিসকে আগের মতো রাখা হলেও তাদের এখানে এলে করণীয় কিছুই নেই। এখনো অনেক ক্ষেত্রে টিওই মূল ভূমিকা পালন করে থাকেন বদলির ক্ষেত্রে। আর অনেক ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যান ভূমিকা পালন করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যান এসব ক্ষেত্রে উদাসীন। তারা এ নিয়ে নাক গলানোর সময় পান না। আবার অনেক টিও রয়েছেন যারা পুরো সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। মেঘনা উপজেলার একজন শিক্ষক জানান, বর্তমান টিও আরিফুল ইসলামের আগের টিও খুবই ভালো ছিলেন। তার বিদায়ে শিক্ষকেরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/233891