৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:১১

বাস্তবায়নের নামে অপব্যয় বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে

এইচ এম আকতার: শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন না হলেও প্রতি বছরই আকার বাড়ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া প্রকল্পের কারণেই এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা। বছরের শেষে এসে তাড়াহুড়া করে অর্থ ব্যয় নামে অপব্যয় বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া এসব প্রকল্পের কারণে সরকারের ওপর ঋণের বোঝা বাড়ছে। কাক্সিক্ষত রাজস্ব না পেলে বড় প্রকল্পের অর্থায়নও বিঘিœত হবে। তবে তাদের শঙ্কা নাকচ করে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, অনেক দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বড় অংকের বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি থাকায় অর্থায়নে ঘাটতি হবে না।

অর্থবছরের শুরুতে একগাদা প্রকল্প নেয়া মাঝামাঝিতে কাটছাঁট আর শেষদিকে বাস্তবায়নের তোড়জোর এটিই এডিপি বাস্তবায়নের চিরাচরিত চিত্র। বিদায়ী অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সাড়ে ১২শ’র বেশি প্রকল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট। সংশোধিত এডিপিতে যোগ হয় আরো ৩শ প্রকল্প। ১১ মাস শেষে বাস্তবায়নের হার ৬৫ ভাগ।
চলতি অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থানের ধারা অব্যাহত থাকলেও জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। তবে সরকার বলছে বিদেশী প্রচুর বিনিয়োগ এখনও পাইপ লাইনে রয়েছে। সরকার চাইলেই তা গ্রহণ করতে পারে। তাই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে না।

প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরেও এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার এডিপি নেয়া হয়েছে। এর ৫৭ হাজার কোটি টাকা আসবে বিদেশী ঋণ থেকে। অথচ বাংলাদেশ বিদেশী ঋণে ৩ বিলিয়নের বেশি ব্যয় করতে পারে না। তবে এ ধারণা নাকচ করে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা রেলসেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে রাশিয়া ও চীন বড় অংকের ঋণ দেবে তাই ঘাটতির শঙ্কা নেই। দেশের তারল্য সংকট নেই। চাইলে অভ্যন্তরীণ খাত থেকেও বেশি ঋণ নেয়া যেতে পারে। গত ৩ বছর ঋণ অনেক কম নেয়া হয়েছে। তাছাড়া পাইপ লাইনে অনেক বিদেশী ঋণ রয়েছে সরকার চাইলেই তা নিতে পারে।

সরকারের এমন মতের ভিন্ন বলছেন, সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, নির্বাচন এলে এডিপির বরাদ্দ বেড়ে যায়। তার সাথে যুক্ত হয়ে থাকে রাজনৈতিক অনেক প্রকল্প। নতুন এডিপিতে বরাদ্দ ও অনুমোদনহীন প্রকল্প অনেক। রাজনৈতিক বিবেচনায় বছরের যে কোনো সময় এগুলো মূল এডিপিতে ঢুকে যেতে পারে।
অবকাঠামো আর বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে করা এডিপি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে সাত দশমিক চার শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারলেও সরকার প্রতিবছরই এটি বাড়িয়ে চলেছে। অর্থবছরের শেষে এসে তাড়াহুড়া করে অর্থ ব্যয় করায় অপব্যয় হচ্ছে। প্রকল্পের মানও হচ্ছে খারাপ। প্রতি বছর এডিপি আকার বাড়লেও বাড়েনি বাস্তবায়ন হার। প্রতি বছরই সরকার একটি বিশাল এডিপি গ্রহণ করে। কিন্তু সরকারের গৃহীত এডিপি কখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মতো হয়ে গেছে। অর্থবছরের শেষের দিকে সরকার বাস্তবায়ন হার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যায়। শেষের দিকে তাড়াহুড়া করার কারণে একদিকে যেমন দুর্নীতি হয় তেমনি প্রকল্পগুলোর গুণগতমানও রক্ষা হয় না। এতে লুটপাটই বেড়ে উঠছে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে না পারলেও জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্যই মূলত বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেটের আকার নয়, সুষ্ঠু বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য কিনা, সেটিই হলো বড় প্রশ্ন।

বড় বাজেট মানে বড় ঘাটতি, আর বাড়তি করের বোঝা। সরকারের ঋণের বোঝা আরো বাড়বে। বড় বাজেটে জনগণের ভাগ্য ফিরলে কথা উঠত না, কিন্তু দেখা যাচ্ছে এতে ভাগ্য ফিরছে দলীয় লোকদের। তাদের সম্পদ বাড়ছে, জনগণের সম্পদ হচ্ছে লুট। চলতি অর্থবছরেও তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে না। মে পর্যন্ত সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) ৬৫ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। কাটছাঁট করে এডিপির আকার ৬০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হলেও এক মাসে বাস্তবায়ন বেড়েছে মাত্র ১২ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে শেষ মাসে আরও ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। উন্নয়ন খাতে অল্প সময়ে এত বেশি অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, তাড়াহুড়ো করে অর্থ ব্যয় করলে উন্নয়ন কাজের গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। নিম্নমানের কাজ করে, এমনকি কাজ না করেও ঠিকাদার প্রকল্পের অর্থ উঠিয়ে নিতে পারে। এতে সরকারি তহবিলের বিপুল অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত ছয় বছরের কোনো বছরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপি বাস্তবায়ন কারতে পারেনি সরকার। অধিকাংশ সময় দুই দফা সংশোধন করতে হয়েছে। অর্থবছরের শেষ দিকে এক দফা এবং পূর্ববর্তী অর্থবছরের হিসাব চূড়ান্ত করার সময় আরও এক দফা সংশোধন করতে হয়। নির্বাচনী বছর আসলেই কেবল এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়ে। এতে কাজের মান ভালো হয় না। বরং দুর্নীতি বাড়ে। আর বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পে সারা বছরই জটিলতা লেগেই থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে এডিপিতে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা বাড়েনি (শতাংশ হিসেবে)। কয়েক বছর আগে সেন্টার পলিসি ফর ডায়ালগ (সিপিডি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের আয় করা সহজ, কিন্তু ব্যয় করা কঠিন। তাদের ভাষায় সরকার ১ টাকা আয় করতে পারলেও, ১ টাকা খরচ করতে পারে না, কাজের মানের অবস্থাও খারাপ।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-–০৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মূল বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন অবস্থা খারাপ হওয়ায় বছরের শেষ ভাগে সেটি ১০ শতাংশ কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় ২৩ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে মূল বরাদ্দ থেকে কমানো হয় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবুও বছর শেষে বরাদ্দের অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও বিভাগগুলো। ওই বছর এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৮৬ শতাংশ। তৃতীয় দফায় এডিপির আকার সংশোধন করতে হয়েছে।

একইভাবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প খাতে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ বছরও বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক না হওয়ায় ছেঁটে ফেলা হয় ৯ শতাংশ বরাদ্দ। ওই অর্থবছরে এডিপিতে মোট খরচ হয়েছে ২৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৯১ শতাংশ।
এদিকে ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল এডিপি ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের মন্থরগতি ও অর্থ সংকটের কারণে বছরের শেষ ভাগে এসে তাও সংশোধন করতে হয়। ওই বছরে সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয় ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ সে বছর উন্নয়ন খাতে মূল বরাদ্দ থেকে ৫ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা কম এবং সংশোধিত বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা কম।
২০১১-১২ অর্থবছরে সরকার ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা করে। বছরের শেষ ভাগে এসে ১১ শতাংশ অর্থ ছেঁটে সংশোধিত এডিপি দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৮০ কোটি টাকায়। এডিপির মূল বরাদ্দ থেকে প্রকৃত বাস্তবায়ন কম হয়েছে ৭ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে খরচ কম হয়েছে ২ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।
২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়। সরকারের নির্বাচনী বছর হওয়ায় শুরু থেকেই অর্থ ব্যয় করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। ওই বছর সরকার ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় এডিপি বাস্তবায়নে হার দাঁড়ায় ৯৬ শতাংশ।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাদ্দ যোগ করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বছরের শেষ দিকে এসে অর্থ সংকটের কারণে এখান থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলার নির্দেশনা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এ হিসাবে কমছে প্রায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে (জুলাই-মে) সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৬২ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৭৭ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে। যা মোট ব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত মে মাসে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ১২২ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে বাস্তবায়ন ব্যয় ছিল ৫৮ হাজার ৭৬ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৬১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিপিতে এক হাজার ৬৬৮টি প্রকল্পে মোট এক লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নের অংশ রয়েছে।
এডিপি বাস্তবায়নের সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাস্তবায়নের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ে এডিপির প্রায় ৯৭ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। এর পরই রয়েছে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এসব মন্ত্রণালয় লক্ষ্যের ৮০ ভাগের বেশি বাস্তবায়ন করেছে। অন্যদিকে ১১ মাস পার হলেও লক্ষ্যের ৪০ ভাগের কম বাস্তবায়ন করেছে এমন দপ্তর রয়েছে সাতটি।

http://www.dailysangram.com/post/290740