৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:০৭

আমাদের সাংবাদিকতা

আত্মপক্ষ

এবনে গোলাম সামাদ :
আমাদের সাংবাদিকতার একটা লক্ষ্য হলো পাঠককে চমকে দেয়া। কেবলই তাদের সংবাদ প্রদান করা নয়। যেমন ক’দিন আগে যুগান্তর পত্রিকায় খবর দেয়া হয়েছিল, সিকিমে মুখোমুখি চীন-ভারত। খবরটি পড়ে যে কারো মনে হতে পারত, সিকিমে ভারত-চীন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। খবরটি পড়ে আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়নি। জানি না, যুগান্তর পত্রিকা এই খবর (৩০ জুন ২০১৭) কেন এভাবে পরিবেশন করা যুক্তিযুক্ত ভেবেছিল। কেননা, এভাবে খবর প্রকাশ করলে একটা পত্রিকার নির্ভরযোগ্যতা কমে যায়। খবরটা পড়ে মনে হচ্ছিল, যুদ্ধ বেধে যাবে। কিন্তু এক দিকে আমরা জেনেছি হিমালয়ে চীন-ভারত যুদ্ধ বাধার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ১৯৬২ সালের ভারত আর আজকের ভারত সামরিক দিক থেকে এক নয়। সে এখন সমরশক্তিতে অনেক শক্তিমান। অন্য দিক থেকে চীন রাজনৈতিক ভাবে হয়ে পড়েছে যথেষ্ট দুর্বল। চীন এখন আর বিশ্বের কাছে আগের মতো পাচ্ছে না রাজনৈতিক সহানুভূতি। কেননা, চীন এখন আর কোনো বিপ্লবী শক্তি নয়। চীন পরিত্যাগ করেছে তার বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা। সিকিম সম্পর্কে আমার ধারণা খুব স্বচ্ছ নয়। সিকিম ছিল ইংরেজ আমলের ব্রিটেনের একটি আরক্ষিত রাজ্য বা প্রটেক্টরেট। সিকিম স্বেচ্ছায় ব্রিটেনের একটি আরক্ষিত রাজ্য হতে চায়। কারণ নেপাল থেকে গোরখারা এসে নাকি সিকিম দখল করতে চেয়েছিল। যেটা সিকিমবাসীর কাম্য ছিল না। সিকিমের লোকদের বলা হয় ল্যাপচা। এরা মঙ্গোলীয় মানবধারাভুক্ত মানুষ। ধর্মে তিব্বতিদের মতো লামা বৌদ্ধবাদী। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর সিকিম গ্রহণ করে ভারতের আরক্ষা। কিন্তু এতে ভারত খুশি হয় না। সে ভাবে সিকিম ঝুঁকে পড়তে পারে চীনের প্রতি। চীন নাকি চাচ্ছিল নেপাল, সিকিম, ভুটান মিলিয়ে হিমালয়ান কনফেডারেশন গঠন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে এপ্রিল মাসে সিকিম দখল করে নেন। এ সময় সিকিম দখল করে নেয়া নিয়ে চীনের সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি হলেও চীন ভারতের সাথে যুদ্ধ করতে অভিলাষী হয়নি। এমনকি সিকিমকে কার্যত ভারতের অংশ বলে সে মেনেই নেয়। কিন্তু এখন আবার সিকিম নিয়ে শুরু হতে পারে চীন-ভারত সঙ্ঘাত সৃষ্টির সম্ভাবনা। যে এলাকা নিয়ে সৃষ্টি হতে পারছে এই গোলযোগ, তা বাংলাদেশের লাগোয়া। আমাদের তিস্তা নদী এসেছে সিকিম থেকে। তিস্তার পানি এখন হয়ে উঠেছে একটা বিশেষ আলোচ্য। ক’দিন আগে দার্জিলিংয়ে গোরখারা বিদ্রোহ করে। গোরখারা বলছে দার্জিলিং নাকি তাদের দেশ। কিন্তু গোরখারা যত দূর জানি এসেছে রাজপুতনা থেকে। তারা কখনোই দার্জিলিংবাসী ছিল না। অথচ এখন দাবি করছে দার্জিলিং হলো তাদের দেশ। কী করে এটা সম্ভব হচ্ছে, আমরা তা জানি না। দার্জিলিং একসময় ছিল রাজশাহী বিভাগের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে দার্জিলিংকে র্যা ডকিফ রোয়েদাদ অনুসারে দেয়া হয়েছিল ভারতকে। দার্জিলিংয়ের ওপর বাংলাদেশের তাই কোনো দাবি নেই। কিন্তু গোরখারা যদি সেখানে যুদ্ধ শুরু করে, তবে তার একটা প্রভাব অবশ্যই আমাদের ওপর এসে পড়তে পারে। তাই গোটা হিমালয় অঞ্চল নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা সেটা করছি বলে মনে হচ্ছে না। আমরা জাতিসঙ্ঘকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করছি। আমরা চাচ্ছি বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে। কিন্তু ভাবছি না আমাদের বাড়ির কাছেই বিশ্বশান্তি ভায়বহরূপে বিঘিœত হতে পারে। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য না পাঠিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য এখন বাংলাদেশে নিজের সৈন্য রাখার ওপরই গুরুত্বারোপ করা উচিত। চীন এবং ভারত উভয়য়ের ওপরই আমাদের সমান নজর রাখতে হবে। কাউকেই চলবে না শত্রু অথবা মিত্র ভাবা। কেননা, এদের উভয়ের সঙ্ঘাত হয়ে দাঁড়াতে পারে আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিল পশ্চিম ইউরোপ রক্ষার ভার। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়েছিল সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ার ভার। ১৯৪৮ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে। ভাবা গিয়েছিল চীন-সোভিয়েত ইউনিয়ন একত্র হয়ে গড়তে চাইবে বিশ্বে সামজতান্ত্রিক সমাজজীবন। কিন্তু তা হলো না। দেখা দিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে মতবাদিক দ্বন্দ্ব। ১৯৯১ সালে বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল। অন্য দিকে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় থাকলেও তারা পরিত্যাগ করল কমিউনিস্ট-দর্শন। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গেল বদলে। কিন্তু তথাপি বাংলাদেশে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী এখনো ভাবেন সামাজতান্ত্রিক সমাজজীবন গড়ার কথা, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি করছে বিশেষ জটিলতা। এরা ঢুকে আছে আওয়ামী লীগে, ঢুকে আছে বিএনপিতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হতে পেরেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সাবেক পাকিস্তান এখন আর নেই। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে হয়েছে আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পাকিস্তান জাতীয়তাবাদকে বাদ দিলে আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের অস্তিত্বের যুক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বাংলাদেশে আবার নতুন করে জাগছে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনা। যেটাকে গ্রহণ করতে হবে আমাদের রাজনীতির একটা বিশেষ উপকরণ হিসেবে। কিন্তু আমাদের দেশের তথাকথিত বাম প্রগতিশীলেরা মনে করছেন এটাকে পরিত্যাগ করার কথা, যা নিয়ে সৃষ্টি হতে পারছে বিশেষ রাজনৈতিক জটিলতা। বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে বিশেষ মতবাদিক সঙ্ঘাত। কিন্তু বাংলা ভাষার অস্তিত্ব একটা বড় বাস্তবতা। আজকের বাংলাদেশ টেকার ওপর নির্ভর করছে তার ভাষা-সাহিত্যের অস্তিত্ব। তাই সেই দিকটি বিবেচনাকেও বাদ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রত্যেকটি দলকেই তাই ভাবতে হবে তার মতবাদিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জাতিসত্তার স্বরূপ নিয়ে।
পত্রিকার খবর পড়ে জানলাম, আমাদের দেশের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারকে নাকি একদল লোক ধরে নিয়ে যান তার কলাম লেখার জন্য। এরকম কাণ্ড ইতঃপূর্বে আর কখনো ঘটেনি। সম্ভবত এরকম ঘটনা আরো ঘটবে। কিন্তু তা বলে মতবাদিক লড়াইয়ে কিছু লোককে সাহসী হতেই হবে।

ফরহাদ মজহার সাংবাদিকতার সাথে বহু দিন জড়িত। তিনি দক্ষিণপন্থী সাংবাদিক নন। তার সঙ্গে যে মতবাদিক সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তাকে বলতে হবে প্রগতিশীলদের সঙ্গে প্রগতিশীলদের সঙ্ঘাত। যেটির অস্তিত্ব আগে ঠিক এভাবে ছিল না।
বিলাতের বিখ্যাত পাক্ষিক পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এ (১ জুন ২০১৭) বলা হয়েছে শেখ হাসিনার নীতি নাকি দ্রুত বদলাচ্ছে। তিনি হাত মিলাচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের সাথে। কেবল তাই নয়, তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হাত মিলাচ্ছেন সৌদি আরবের সাথে। ইকোনমিস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা অনেকে ইকোনমিস্ট পড়ে প্রভাবিত হন। তাই হয়তো দেখা যাবে যে, নিকট ভবিষ্যতে আমাদের দেশে তথাকথিত প্রগতিশীলেরা আর আগের মতো খোয়াব দেখাতে পারছেন না। বদলে যাচ্ছে সাংবাদিকতার ধারা। অবশ্য সাংবাদিকতার ধারা যে আমাদের দেশেই বদলাচ্ছে, তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা দেখছি সাংবাদিকতার ধারা অনেক বদলাচ্ছে। সাংবাদিকেরা হয়ে উঠছেন অনেক বেশি মার্কিন জাতীয়তাবাদী। সারা বিশ্বেই এখন জাতীয়তাবাদ আবার প্রাধান্য পেতে চলেছে। ম্লান হয়ে পড়েছে কার্ল মার্কসের শ্রেণী-সংগ্রামবাদ। মানুষ বাঁচতে চাচ্ছে জাতিসত্তা নির্ভর করে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/233782