৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১১:০৬

গুম-খুনের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

আশিকুল হামিদ : চমৎকার একটি প্রশ্ন রেখেছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। আওয়ামী লীগ সরকারের খুবই তৎপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তার বক্তব্য ও কার্যক্রমের প্রতি সব সময় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখেন। এই সময়ে লক্ষ্য রাখার প্রধান কারণ সৃষ্টি হয়েছে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের কথিত অপহরণকেন্দ্রিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে। পাঠকরা অবাক হতে পারেন, কিন্তু আপহরণের আগে জেনে-বুঝেই ‘কথিত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর বদৌলতে সারা দেশে বিরামহীনভাবে গুমের হাওয়া বইতে থাকায় ফরহাদ মজহারের বিষয়টিকেও আপহরণ হিসেবেই ধরে নেয়া হয়েছিল। এখনো, ৭ জুলাই বিকেল পর্যন্তও ৩ তারিখের কথিত ওই অপহরণ রহস্যের কোনো কূলকিনারা হয়নি। সত্যিই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল নাকি ফরহাদ মজহার নিজেই অপহরণের নাটক সাজিয়েছিলেন- এ ধরনের অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়েই জোর আলোচনা চলছে। ফরহাদ মজহার বা তার পরিবারের সদস্যরা যেমন মুখ খুলছেন না তেমনি র্যা ব পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের দিক থেকেও কিছু জানা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মেই ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের গুজব। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও এসব গুজবের ভিত্তিতেই খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
আমরা অবশ্য গুজবে কান দেয়ার পক্ষপাতী নই। একই কারণে আবার একথা না বলেও পারা যাচ্ছে না যে, পানি এরই মধ্যে যথেষ্ট ঘোলা করা হয়েছে, যার ফলে ‘ট্রমাটাইজড’ বা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়া ফরহাদ মজহারের কথিত অপহরণের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে সত্য সম্ভবত কোনোদিনই জানা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অবশ্য আশার কথা শুনিয়ে রেখেছেন- তদন্ত চলছে এবং তদন্ত শেষে সঠিক তথ্য জনগণকে জানানো হবে। ফরহাদ মজহারের এই একটি বিষয়ে সংযম দেখানোর এবং সংযত বক্তব্য রাখার কারণে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কারণ, শুরু থেকেই তিনি এক সুরে কথা বলেছেন- যদিও তারই একটি কথায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুতর সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, অনেকটা হঠাৎ করেই তিনি বলে ফেলেছিলেন, অপহরণকারীরা ফরহাদ মজহারকে ভারতে নিয়ে যেতে পারলে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারতো। হঠাৎ ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন কেন- সে প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনো পাওয়া যায়নি।

এবার সর্বশেষ প্রসঙ্গ। ফরহাদ মজহারকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সংযমের জন্য প্রশংসিত হলেও একই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার নিন্দিত হয়েছেন তার একটি প্রশ্নের কারণে। প্রশ্নটি তিনি করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে। রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নটি উল্লেখ করা যাক। তিনি জানতে চেয়েছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘গায়ে পড়ে’ কথা বলতে আসে কেন? এদেশে ‘গায়ে পড়ে’ ঝগড়া বাঁধানো সম্পর্কিত প্রবাদ বা কাহিনীর সঙ্গে আমাদের সবারই কম-বেশি পরিচয় আছে। কিন্তু মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘গায়ে পড়ে’ কথা বলতে আসা প্রসঙ্গে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে যেসব তথ্য-পরিসংখ্যান এবং মন্তব্য ও পরামর্শ রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে মন্ত্রী একমত নন। তিনি বরং ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত বলেই আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংস্থাটিকে যথেষ্ট কঠোর ভাষায় ‘এক হাত’ নেয়ার কসরত করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটা তার অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে! সুতরাং তাকে দোষ দেয়ার সুযোগ নেই। মন্ত্রী, তাও আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে থাকতে হলে ওই কর্তব্যে অবহেলা দেখানোর কথা কল্পনাও করা যায় না। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মিস্টার কামাল শুধু প্রশ্ন করেই থেমে যাননি, ‘গায়ে পড়ে’ যুক্ত প্রশ্নটি করার কারণ সম্পর্কেও জানিয়েছেন। বলেছেন, যৃদ্ধ অপরাধীদের বিচারের সময়ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আরো অনেক উপলক্ষেই সংস্থাটি সরকারবিরোধী ভূমিকা পালন করেছে বলেই মাননীয় মন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, তারা কেন ‘গায়ে পড়ে’ কথা বলতে আসে। কথাটার অর্থ, সরকার যদি চায় বা অনুমতি দেয় বা অনুরোধ করে তাহলেই কেবল কথা বলতে পারবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ! ‘আগ বাড়িয়ে’ কোনো কথা বলা চলবে না!

অন্যদিকে সত্য কিন্তু অন্য রকম। অসত্য বলার প্রশ্ন ওঠে না, আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংস্থাটি আসলে নতুন কিছুও বলেনি। সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের কয়েকশ’ নেতা-কর্মীকে গুম করেছে এবং অবৈধভাবে আটক করে রেখেছে। এদের ব্যাপারে সরকার সব সময় অভিযোগ নাকচ করেছে অথবা নীরবতা অবলম্বন করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার রিপোর্টে গুম, গুপ্তহত্যা এবং গোপন বন্দিশালা বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার সমালোচনা করে সংস্থাটি বাংলাদেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কাজে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনকে নিযুক্তি দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। ‘তিনি আমাদের কাছে নেই : বাংলাদেশে গোপন আটক আর গুম’ শিরোনামে প্রকাশিত ৮২ পৃষ্ঠার রিপোর্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিশেষ করে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হওয়াদের সম্পর্কে তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। সঙ্গে রয়েছে সরকারের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শও। এতেই তেড়ে উঠেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। জানতে চেয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি কেন ‘গায়ে পড়ে’ কথা বলতে এসেছে!

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হলেও বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো একটি বিষয়েই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অসত্য বলেনি বরং সত্যই তুলে ধরেছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বিশ্বের সব দেশেই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ডকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, একই সঙ্গে দেখা হয় অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গেও। গণতান্ত্রিক কোনো দেশে রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা বা কর্মীকে গুম করা হবে এবং পরে এখানে-সেখানে তার লাশ পাওয়া যাবে এমনটা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন হয়ে পড়া বাংলাদেশে গুম শুধু হচ্ছেই না, অনেকের এমনকি খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে। সঙ্গে তার ড্রাইভারও ছিল। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ মেলেনি। মাঝখানে বছর চারেক আগে তার ছোট ভাই অভিযোগ করেছিলেন, ইলিয়াস আলীকে নাকি কলকাতার আশপাশে ভারতের কোনো কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য কোনো দেশ হলে সরকার সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠতো এবং ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বলে কথা! তৎপর হয়ে ওঠা দূরে থাকুক সরকার এমনকি টুঁ শব্দটিও করেনি। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন। আমিনুল ইসলামের লাশ তবু টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে পাওয়া গিয়েছিল। আরো অনেকের লাশও দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী বা খালের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের মতো বেশিরভাগেরই এখনো কোনো খবর নেই।

কথা শুধু এটুকুই নয়। দায়িত্ব যেখানে ছিল গুম-খুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, সরকার সেখানে এ সংক্রান্ত খবর যাতে প্রকাশিত না হতে পারে সে ব্যাপারেই বেশি তৎপরতা দেখিয়ে চলেছে। কিন্তু সরকারের এই চেষ্টায় কোনো ত্রুটি না থাকলেও দেশের ভেতরে শুধু নয় অন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়টি ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও আলোচিত হয়েছে। এখনো যে হচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ২৮ মার্চ প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এক রিপোর্টেও। রিপোর্টে বাংলাদেশে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ‘উচ্চ হারে’ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার বিষয়ে রাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সরকারের পেশ করা রিপোর্টের পর্যালোচনা ও এ সংক্রান্ত শুনানির পর প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে ক্ষমতাসীনদের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব না দেয়ার কারণেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এরও আগে কমিশন বিষয়টি নিয়ে শুনানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপি)-এর এক উন্মুক্ত অধিবেশনের আয়োজন করেছিল। গত ৬ ও ৭ মার্চ জেনেভায় অনুষ্ঠিত এই উন্মুক্ত অধিবেশনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মাধ্যমে সরকার নিজের বক্তব্য উপস্থাপান করেছে। কিন্তু সে বক্তব্য বা কৈফিয়ৎ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি জাতিসংঘের সংস্থাটি। পর্যবেক্ষণ আকারে প্রকাশিত রিপোর্টে সরকারের বক্তব্যের ভিত্তিতে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি কতিপয় সুপারিশও তুলে ধরেছে কমিশন। এসব সুপারিশের মধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে মানবাধিকার লংঘনের সকল অভিযোগ তদন্ত করার পূর্ণ ক্ষমতা ও অধিকার দেয়ার কথা এসেছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ‘পারিস নীতিমালা’ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে এবং আইসিসিপি সনদের উল্লেখ করে জাতিসংঘ কমিটি বলেছে, সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে ও বলবত রাখতে পারে না, যেসব আইন ওই সনদের পরিপন্থী।

প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের উল্লেখ করেছে কমিশন। বলেছে, এ দুটি আইনের ব্যাখ্যা এতই ব্যাপক যে, যে কোনো সরকারই তার স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে ব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করতে পারে। আইন দুটির অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ যে ঘটেছে ও ঘটে চলেছে এবং সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরাও যে তার শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন- তারও উল্লেখ রয়েছে পর্যবেক্ষণে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে জাতিসংঘ কমিশন বলেছে, আইনশৃংখলা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকায় দোষীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না, অন্যদিকে ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোও ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। দেশের আইনে অপরাধ হিসেবে গুমের স্বীকৃতি না থাকার কারণেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ কমিশন। পর্যবেক্ষণের সুপারিশে কমিশন বলেছে, সকল বাহিনীর জন্যই আইনে জবাবদিহিতার এবং দোষীদের শাস্তির বিধান যুক্ত করতে হবে। আটক অবস্থায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং কারা হেফাজতে মৃত্যুর ব্যাপারেও নিন্দা জানানো হয়েছে পর্যবেক্ষণে।

মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার অধিকারসহ আরো কিছু বিষয়েও প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বক্তব্য রেখেছে জাতিসংঘ কমিশন, কিন্তু বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সরকারের চালানো দমন-নির্যাতনের নানাদিক। বলা বাহুল্য, কোনো একটি প্রসঙ্গেই আলোচ্য পর্যবেক্ষণে সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অন্য কিছু প্রতিষ্ঠানও এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো রিপোর্টে একথা পর্যন্তও বলা হয়েছে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন মামলা দায়ের করার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, হত্যা ও গুম হওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা প্রসঙ্গও রয়েছে প্রায় সব রিপোর্টে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার যে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি- এমন মন্তব্যও করেছে বিভিন্ন বিদেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজও অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছে। বড় দলগুলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মনে হচ্ছে, সংসদের বাইরেও কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না সরকার। সরকারের সমালোচনা করার কারণে গণমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিক ও সম্পাদকদের অভিযুক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে।

আরো অনেক তথ্য ও অভিমতও রয়েছে বিভিন্ন বিদেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে। সেদিক থেকে বলা যায়, জাতিসংঘ কমিশন যেমন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচও তেমনি আসলে নতুন কিছুই বলেনি। বস্তুত সরকার স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার কারণে বাংলাদেশে একদিকে বিরোধী গণতান্ত্রিক দলগুলো আন্দোলন দূরে থাকুক এমনকি সাধারণ কোনো কর্মসূচিও পালন করতে পারছে না, অন্যদিকে এসব দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি আক্রান্ত অন্য সকলের জন্যও ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানতেই হবে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও জাতিসংঘ কমিশনের রিপোর্ট ও পর্যবেক্ষণে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য সঠিকভাবেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী তথা নিরাপত্তাবাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে, যাদের পেছনে রয়েছে সরকারের সমর্থন ও মদদ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের, প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার, গ্রেফতারের পর রিম্যান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো বিভিন্ন প্রসঙ্গেও রিপোর্ট ও পর্যবেক্ষণে সঠিক তথ্য ও চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। এসব কারণেই হিউম্যান রাইটস ওায়াচের রিপোর্ট ও জাতিসংঘ কমিশনের পর্যবেক্ষণের কোনো একটি বিষয়ের সঙ্গেই ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ নেই।
বলাবাহুল্য, এই রিপোর্ট ও পর্যবেক্ষণ সরকারের জন্য সুখবর হয়ে আসেনি। এজন্যই কেবলই প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে সরকারের উচিত রিপোর্ট ও পর্যবেক্ষণের মূল কথাগুলো অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করা। বিষয়টি জরুরি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালীসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশই বিভিন্ন সময়ে গুম-খুনের কঠোর বিরোধিতা করেছে। এখনো করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বেশ কিছু উপলক্ষে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ইলিয়াস আলীর গুম এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি কঠিন হয়ে পড়বে। বলা দরকার, বিদেশিদের হুমকির কারণে শুধু নয়, দেশের ভেতরে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে সরকারের উচিত কঠোর অবস্থান নেয়া। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যার পেছনে তাদের ইন্ধন ও ভূমিকার বিষয়টি কারো কাছেই আর গোপন নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও যখন অভিযোগ উত্থাপন করে তখন বোঝা দরকার, দেশের ভাবমর্যাদা তো ক্ষুণ্ন হয়েছেই, এমন অবস্থা কোনো সরকারের ভবিষ্যতের জন্যও শুভ হওয়ার নয়। সুতরাং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মামলা ও গ্রেফতারসহ বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং দোষীদের শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি সরকারের উচিত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেও সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একযোগে সচেষ্ট হয়ে ওঠা।

http://www.dailysangram.com/post/290728