কক্সবাজারের রাস্তাঘাট এখন বন্যার পানিতে থৈ থৈ। ছবিটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের
৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৫৯

বন্যা ও পাহাড়ধসে ৯ জনের মৃত্যু

চকরিয়ায় তিন লাখ মানুষ চরম দুর্দশাগ্রস্ত

কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা অপরিবর্তিত রয়েছে। পাহাড়ি ঢলে জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যার পানি বেড়েছে। তবে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কিছু কিছু উঁচু এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে। এতে নি¤œাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়ে চলেছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। একই সাথে এসব এলাকার মানুষজন নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাও। সব মিলিয়ে নারী, শিশু ও বয়স্কদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। বন্যাদুর্গত এলাকার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্যা ও পাহাড়ধসে গত দুই দিনে আরো ছয়জনসহ মোট ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। উখিয়ায় বন্যায় ভেসে যাওয়া দুই শিশুর মধ্যে একটির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্য দিকে উখিয়ার পালংখালীর আনজুমানপাড়ায় দেয়াল চাপায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় এই ঘটনাটি ঘটেছে। বুধবার বিকেলে নাই্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের আজুখাইয়া ফকিরপাড়া এলাকায় পাহাড়ধসে চেমন খাতুন (৫৫) নামে বয়োবৃদ্ধ মহিলার মৃত্যু হয়েছে। নিহত চেমন খাতুন ওই এলাকার আবদুল মাজেদের স্ত্রী। নাই্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম সরওয়ার কামাল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে প্রধান প্রধান সড়কের ওপর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। জেলার প্রধান দু’টি নদী মাতামুহুরী ও বাঁকখালীর পানি বিপদসীমার অন্তত ৪ ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখনো তলিয়ে আছে জেলা সদর, চকরিয়া, পেকুয়া ও রামুসহ জেলার দেড় শতাধিক গ্রাম। এখনো পানিবন্দী অন্তত চার লক্ষাধিক মানুষ। মাতামুহুরী নদীর উভয়পাশে গ্রামগুলো অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। বাঁকখালী নদীর উভয়পাশে অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী।

চকরিয়া, রামু ও ঈদগাঁও এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্যাকবলিত মানুষ। পাহাড়ধসে গতকাল সন্ধ্যায় উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়ার সরওয়ারের শিশুপুত্র সাব্বির ও গত মঙ্গলবার মহেশখালী উপজেলার হোয়ানকে মোনার আলমের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ি ঢলে মঙ্গলবার ঈদগাওতে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। টানা বর্ষণের ফলে কক্সবাজারে পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো থেকে মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তিন শতাধিক পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন। জেলার অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। জেলার বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। খাবার পানি সংগ্রহ করতে পানিবন্দী মানুষজনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পানিতে তলিয়ে গেছে আন্তঃসড়কগুলো। ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধসহ বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়ক ও কালভার্ট। এভাবে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে জেলায় বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানান, বন্যাকবলিত এলাকার মধ্যে চকরিয়া ও কক্সবাজার সদরে ১০০০ খাবার প্যাকেট ও দুই লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। প্রস্তুত করা হয়েছে জেলার আশ্রয়ণকেন্দ্রসমূহ। দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশাসন সব রকম প্রস্তুতি নিয়েছে। প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিস্থিতি পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
ঢল ও বৃষ্টির পানিতে নি¤œাঞ্চলের প্লাবিত হওয়ায় রাস্তাঘাট ভেঙে ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ। এতে জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। তলিয়ে গেছে কৃষি ফসল ও চিংড়ি ঘের।
স্থানীয় সূত্র জানায়, অতি বর্ষণে জেলার মিঠাপানির তিন নদী চকরিয়ার মাতামুহুরি, ঈদগাঁওর ফুলেশ্বরী ও কক্সবাজারের বাঁকখালীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের পানি।
ঢলের তীব্রতায় ভেঙে যাওয়া ঈদগাঁওর রাবার ড্যাম এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে বৃহত্তর ঈদগাঁওর জালালাবাদ, ঈদগাঁও, চৌফলদণ্ডী, পোকখালী ও ইসলামাবাদ এলাকার অর্ধশত গ্রামের রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। ভেঙে গেছে আঞ্চলিক সড়কগুলো।

এ ছাড়া কক্সবাজার শহরসহ চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, রামুসহ বেশ কয়েক উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঢলের পানির সাথে বৃষ্টির পানিতে ওই সব এলাকায় কোমর সমান পানি জমে গেছে।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অতি বর্ষণে পাহাড়ধসে অনাকাক্সিক্ষত যেকোনো দুর্ঘটনা এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরাতে কাজ চলছে। জরুরি সভা করে পাহাড়ে অবস্থানকারীদের সরিয়ে এনে আশ্রয় কেন্দ্র নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন, রাজাখালী, মগনামাসহ সব ক’টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। এসব স্থানের অনেক লোকজন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র ও ইউপি ভবনসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। বাঁকখালী নদীর পানি উপচে পড়ে রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল ও ফতেখাঁরকুলে ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সড়কে কোমর সমান পানির কারণে যান চলাচলে বিঘœ হচ্ছে। জালালাবাদের প্যানেল চেয়ারম্যান ওসমান সরোয়ার ডিপো জানান, জালালাবাদ ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভাঙনে ও ঢলের পানিতে চৌফলদণ্ডী, ঈদগাঁও, পোকখালী, ইসলামাবাদসহ পাশের ইউনিয়নগুলোর প্রায় অর্ধলাখ পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভাঙা বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট পরিদর্শন করেছেন।

এদিকে কক্সবাজারে প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় আরো ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। রামুতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই সহোদর শিশু প্রাণ হারিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় রামু উপজেলার উত্তর ফতেখাঁরকুল চালইন্নাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলো ওই এলাকার কামাল হোছনের ছেলে মো: শাহিন (১০) ও মো: ফাহিম (৮)। বাড়িতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশু দু’টি নানার বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে প্রবল স্রোতে তারা ভেসে যায়। স্থানীয়রা শিশু দু’টির লাশ উদ্ধার করে। রামু থানার ওসি এম লিয়াকত আলী ও ফতেখাঁরকুল ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম দুই সহোদরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উখিয়ার সোনাইছড়িতে বন্যার স্রোতে নিখোঁজ মাদরাসাছাত্রী সামিরা আক্তারের (১৪) লাশ উদ্ধার হয়েছে। বৃহ¯পতিবার দুপুর নিহতের লাশ উদ্ধার করা হয়। সে সোনাইছড়ি জাফর আলমের কন্যা এবং সোনাইছড়ি আয়েশা সিদ্দিকা বালিকা মাদরাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মাঈনুদ্দিন জানান, পালংখালী ইউনিয়নের আনজুমান পাড়ার সরওয়ার আলমের শিশুপুত্র রাব্বি (৭), মধ্যম রতœাপালং গ্রামের মৃত অমূল্য বড়–য়ার ছেলে ইতুন বড়–য়া (১৫) ও রতœাপালং সাদৃকাটা গ্রামের কামাল উদ্দিন (৬০) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
উখিয়ায় ঘরে ঘরে হাঁটু পানি
উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে উখিয়ায় জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। নি¤œাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে হাঁটুপানি জমে চুলায় রান্না করতে না পারায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অনেককে। সড়কগুলো এখন পানিতে থৈ থৈ। থাইংখালী, পালংখালী, বালুখালী, কুতুপালং, উখিয়া সদর, ঘিলাতলীপাড়া, মহুরীপাড়া, ফলিয়াপাড়া, মাছকারিয়া, হাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, সিকদারবিল মালভিটা, রতœাপালং, ভালুকিয়াপালং, কোটবাজার, চৌধুরীপাড়া, গোরাইয়ারদ্বীপ, উপকূলীয় এলাকা জালিয়া পালংসহ আরো অনেক এলাকার রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় মানুষ সীমাহীন কষ্টে পড়েছে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উখিয়ার জনজীবন। উখিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বৃষ্টিতে এখানকার অলিগলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন বাড়িঘরের টয়লেট ও ড্রেন থেকে ময়লা আবর্জনা সড়কে ছড়িয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে থাকায় রাস্তাগুলোও ভেঙে একাকার হয়ে পড়েছে। জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়ে স্কুলগামী শিার্থীরা। সকালে জলাবদ্ধতায় শিার্থীদের হাঁটুপানি ডিঙিয়ে যেতে হয়েছে শিাপ্রতিষ্ঠানে। উখিয়া কেজি স্কুলের কাস ও অফিস রুম হাঁটুপানিতে থৈ থৈ করছে। ফলে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৃষ্টির ভোগান্তির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে পরিবহন সঙ্কটও। সুযোগ পেয়ে রিকশা, টমটম, সিএনজি চালকেরা হাঁকছেন দু-তিনগুণ ভাড়া।

চকরিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারের চকরিয়ায় মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার অন্তত তিন লাখ মানুষ। কোথাও তিল পরিমাণ শুকনো জায়গা নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেয়ার। বন্যাদুর্গত বেশির ভাগ মানুষের আশ্রয়স্থল এখন উঁচু টিলা, বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কের ওপর। এই অবস্থায় শিশু, বৃদ্ধরা বেশি পড়েছেন বেকায়দায়। গত চার দিন ধরে এই অবস্থা অব্যাহত থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ত্রাণতৎপরতা চালানো হয়নি। শুধু বুধবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন লাখ বানভাসি মানুষের বিপরীতে মাত্র এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে শুকনো খাবার, স্যালাইন ও পানি বিতরণের জন্য। নামমাত্র এই বরাদ্দ দেয়ার খবর জানার পর ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন অনেক জনপ্রতিনিধি।

তবে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এই বরাদ্দ প্রাথমিকভাবে দেয়া হয়েছে। আরো বেশি করে ত্রাণ তৎপরতা চালানো হবে। এরই মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী, সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ পাঁচ লাখ টাকা।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘চার দিনের অব্যাহত ভারী বর্ষণ এবং মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে এখনো তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর দু-একদিনের মধ্যে আরো ব্যাপক পরিসরে ত্রাণতৎপরতা চালানো হবে। শুরু থেকেই বন্যা পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি আমরা, এ জন্য এখনো পর্যন্ত একজন মানুষও মারা যাওয়া বা নিখোঁজ থাকার খবর পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসনিকভাবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেখানে যেখানে বেশি সমস্যা হচ্ছে সেখানে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে তৎপর রয়েছি। তদারকি রুম খুলে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক খবরাখবর নেয়া হচ্ছে। পুরো উপজেলার কোথাও ১২ ফুট আবার কোথাও ৭-৮ ফুট পানির নিচে তলিয়ে থাকায় অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।’
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ সব ক’টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি ঢুকে পড়ছে নদ-নদী তীরবর্তী চরের নি¤œাঞ্চলগুলোতে।

পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের বজড়া বিয়ারখাতা, খেরুয়ার চর, খেদাইমারী, ফেসকার চর, নাইয়ের চর, দুইশোবিঘাসহ প্রায় ২০টি গ্রাম, অষ্টমীরচর ইউনিয়নের মুদাফত কালীকাপুর, ডাটিয়ারচর, নটারকান্দি ও দিঘলকান্দিসহ প্রায় ১৫টি গ্রাম, চিলমারী ইউনিয়নের মানুষমারার চর, আমতলার চর, কড়াই বরিশালসহ প্রায় ১০টি গ্রাম ও সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের তিনহাজারীর চর, ভগবতীর চর, খেয়ার আলগার চর, চর যাত্রাপুর, চরপারবতীপুরসহ প্রায় ১২টি গ্রামসহ প্রায় শতাধিক গ্রামের মানুষ। এ ছাড়াও নতুন জেগে ওঠা চরের ঘরবাড়িগুলো প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ।
এ অবস্থায় গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দী মানুষেরা। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে জেলার নদ-নদী তীরাবর্তী প্রায় ২ শতাধিক চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়বে।
অন্য দিকে রৌমারী উপজেলার সাহেবের আলগা বিজিবির বিওপি ক্যাম্প-সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের বামতীর রক্ষা প্রকল্পের ৯০ মিটার বাঁধ ধসে গেছে।
চিলমারী উপজেলার নয়ারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু হানিফা জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আমার ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। নদের পানি এভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পুরো ইউনিয়নের মানুষজন পানিবন্দী হয়ে পড়বে।
চিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গওছল হক মণ্ডল জানান, এ বছর প্রথম আমার ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের কিছু বাড়ি বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি পেতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ঘিওর (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদীর তীব্র ভাঙনে বিলীন হয়েছে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভাঙনকবলিত ইউনিয়নগুলো হলো চরকাটারী, বাঁচামারা ও বাঘুটিয়া ইউনিয়ন। চলতি মওসুমে তিন শতাধিক বাড়িঘর, আবাদি জমিজমা বিলীন হয়েছে। সহায় সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ওইসব এলাকার নদীভাঙনকবলিত মানুষেরা।
ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে চরকাটারী ইউনিয়নের লালপুর, চরকাটারী, কাঁঠালতুলি, চরকাটারী মণ্ডলপাড়া, বোর্ডঘর বাজার, চরকাটারী বাজার এলাকায়। যমুনা নদীর পাড়ে চরকাটারী ইউনিয়নে জিও ব্যাগ ফেলে অস্থায়ীভাবে করা প্রতিরামূলক বঁাঁধে ধস দেখা দেয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে ওইসব এলাকার শিাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ইউনিয়ন পরিষদ, ভূমি অফিসসহ শত শত বাড়িঘর, জায়গা-জমি।
এ বছর নদীতে পানি আসার মাসখানেক আগে চরকাটারী ইউনিয়নে যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ে যমুনা নদী ভাঙন রোধকল্পে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে অস্থায়ী প্রতিরা বাঁধ তৈরি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু নদীর তীব্র স্রোতে ও নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় সেই প্রতিরামূলক বাঁধ। ফলে ঐতিহ্যবাহী চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চবিদ্যালয়, চরকাটারী বাজার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদরাসা ও শত শত বাড়িঘর, আবাদি জমি ভাঙনের হুমকির মুখে পড়ে যায়।
বুধবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার ওই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ ঘরবাড়ি-জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজের ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যের জমির ওপর আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

চরকাটারী মণ্ডলপাড়ার আবদুল খালেক মণ্ডল এ প্রতিবেদককে জানান, নদীতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙন শুরু হয়। এবার নিজের বাড়িতে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
চরকাটারী বোর্ডঘর বাজার এলাকার আলমগীর হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, যমুুনা নদীর ভাঙনে বাড়িঘর, জায়গাজমি নদীতে বিলীন হওয়ায় গরু-ছাগল নিয়ে এখন অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে কোনো মতে থাকছেন।
এ বিষয়ে চরকাটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল বারেক মণ্ডল জানান, যমুনা নদীর ভাঙনে চরকাটারী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ কেন্দ্র, দ্’ুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শত শত বাড়িঘর, আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে। তিনি ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর পদপে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে প্রতি আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল হামিদ বলেন, তারা ইতোমধ্যে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং অর্থ বরাদ্দের জন্য কর্তৃপরে কাছে পত্র প্রেরণ করা হযেছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কানিজ ফাতেমা বলেন, যমুনা নদী ভাঙন রোধ কল্পে করা অস্থায়ী প্রতিরামূলক বাঁধের কিছু কিছু স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ওসমানীনগরে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ
ওসমানীনগর (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, সিলেটের ওসমানীনগরে হাওরপাড়ের বানভাসি মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার বিরাজ করছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে গ্রামের মানুষেরা নাও নিয়ে ছুটছেন দূর গ্রামের দিকে। উপজেলার আট ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামের সাথেই সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মধ্য সাময়িক পরীক্ষা চলাকালীন বন্যার পানিতে আক্রান্ত হওয়ায় বিঘœ ঘটছে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা। বানের পানির সাথে এলাকায় বাড়ছে রোগবালাই। বন্যায় আক্রান্ত এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্বরসহ শিশুদের মাঝে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ আসছে তা অপ্রতুল।
উপজেলার আট ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামই এখন প্লাবিত রয়েছে। উপজেলার নি¤œাঞ্চল বলে পরিচিত সাদীপুর ইউনিয়নের সুরিকোনা গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয়ভাবে একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এলাকার বন্যাকবলিত বেশ কয়েকটি পরিবার সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। উপজেরার আট ইউনিয়নের প্লাবিত গ্রামগুলোতে পানিবাহিত রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য নি¤œাঞ্চলের স্থানীয়রা ছুটছেন দূরের গ্রামে। উপজেলার নি¤œাঞ্চলের গ্রামে যাতায়াতের যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যম পাকা সড়কগুলোও প্লাবিত রয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সাধারণ মানুষদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান বলেন, এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় সরকারের পক্ষ থেকে তিন ধাপে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রথম দিকে ছয় টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে ১৪ টন চাল চাল বরাদ্দ এসেছিল এবং গতকাল ৬ জুলাই এসেছে আরো ২৪ টন। উপজেলার আট ইউনিয়নের জন্য ১০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি রয়েছে। খাবার স্যালাইন রয়েছে পর্যাপ্ত।
বগুড়ায় ১০ স্কুল বন্ধ ঘোষণা
বগুড়া অফিস ও সারিয়াকান্দি সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এতে নতুন নতুন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। ওই এলাকার ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া নদীভাঙনের ফলে ধারা বরিষার চরের শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বগুড়ার ডিসি নূরে আলম সিদ্দিকী নদীভাঙ্গনকবলিত কামালপুর ইউনিয়নের রৌহাদহ এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে পানিবন্দী শতাধিক পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। এ সময় তিনি ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের ঘোষণা দেন। তখন তার সাথে উপস্থিত ছিলেন সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সারোয়ার আলমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
সিলেটে ৭৮টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে

সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটের বন্যা উপদ্রুত এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁঁকি মোকাবেলায় ৭৮টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। এ ছাড়া আরো ৭০টি মেডিক্যাল টিম প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের নানা ধরনের সমস্যা এবং রোগব্যাধি থেকে সচেতন করার জন্য ও পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এসব মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা: হিমাংশু লাল রায় গতকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে এ তথ্য জানান। সিভিল সার্জন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সবার সহযোগিতা কামনা করে বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। কোনো মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সে জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে। ডা: হিমাংশু লাল রায় জানান, বন্যায় তিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে সিলেটের ১৩টি উপজেলার উপদ্রুত সাতটি উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নে ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সিলেট জেলার আক্রান্ত ১৩টি উপজেলায় ৫৪৭৩৯২ জন লোক আক্রান্ত হয়েছেন।
মতবিনিময় সভায় সিভিল সার্জন আরো জানান, বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যমান টিকিয়ে রাখতে জেলা রিজার্ভ স্টোরে ১০৯০০০ লিটার পানি বিশুদ্ধকরণ ওষুধ, ৮৯০০০টি খাবার স্যালাইন সংরতি আছে। এ ছাড়া ডাইরিয়া ও কলেরা দূরীকরণে ৩৪০০টি আইভি ফুইড মজুদ আছে। এ ছাড়া বন্যায় আক্রান্ত মানুষকে রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে সিপ্রোফক্সাসিলিন, এন্টিভেনম, টেট্রাসাইকিন ওষুধ মজুদ রয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/233579